কলিঙ্গ যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল আলোচনা করো

কলিঙ্গ যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল আলোচনা করো
কলিঙ্গ যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল আলোচনা করো

কলিঙ্গ যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল আলোচনা করো

  • অথবা, কলিঙ্গ যুদ্ধ ভারতীয় ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা ব্যাখ্যা কর।
  • অথবা, কলিঙ্গ যুদ্ধের কারণ ও প্রভাব পর্যালোচনা কর।

উত্তর : ভূমিকা : প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে মৌর্য বংশের অন্যতম একজন শাসক ছিলেন সম্রাট অশোক। অশোক ক্ষমতায় এসেই পূর্বপুরুষদের ন্যায় শাসন পরিচালনা করেন। 

কিন্তু তার শাসনামলের সবচেয়ে বিভীষিকাময় মর্মান্তিক কলিঙ্গের যুদ্ধ সংঘটিত হয় । সে যুদ্ধে প্রায় এক লক্ষ লোক প্রাণ হারায়। তবে এ যুদ্ধের পর সম্রাট অশোকের মনে পরিবর্তন আসে। 

তিনি অনুশোচিত হন এবং বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন। সম্রাট অশোকের আমলে এই মর্মান্তিক যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার পেছনে কারণ ও ফলাফল রয়েছে।

→ কলিঙ্গ যুদ্ধের কারণ : সম্রাট অশোক কেন কলিঙ্গ আক্রমণ করেছিলেন তার কোনো কারণ শিলালিপিতে পাওয়া যায় নি । 

নিম্নে কলিঙ্গ যুদ্ধের কারণসমূহ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :

১. জোটের ভীতি : অশোক সিংহাসনে বসে দেখেন যে, মগধের অধীনস্ত অা, উত্তর কলিঙ্গ এবং দক্ষিণে ঢোল ও পাশুদের দ্বারা বেড়াজালে পড়ে গেছে। একারণে তিনি জোটের ভয়ে কলিঙ্গ আক্রমণ করেন।

২. সামরিক ক্ষমতা : খর্ব করা কলিঙ্গ রাজ্য নিন নিন তার সামরিক ক্ষমতা বৃদ্ধি করে চলছিল। প্রতিবেশী এমন একটা শক্তিকে সহ্য করা অশোকের জন্য কঠিন ছিল। ভাই অশোক কলিঙ্গের সামরিক ক্ষমতা খর্ব করার জন্য অভিযান পরিচালনা করেন।

৩. রাজ্য জয়ের নেশা : সম্রাট অশোক ছিলেন একজন বিজেতা ও উচ্চাকাক্ষী শাসক এ কারণে সিংহাসনে আরোহণ করেই তিনি সাম্রাজ্য বিস্তারের দিকে মনোনিবেশ করেন। আর রাজ্য বিস্তারের অষ্টম বছরে সংঘটিত হয় কলিঙ্গ

৪. দক্ষিণ ভারতে যাবার সুবিধা : সম্রাট অশোক দক্ষিণ ভারতে যাবার স্থল ও জলপথকে নিরঙ্কুশ করার জন্য কলিঙ্গ জয়ের নেশায় ও শুদ্ধ হন। 

কলিঙ্গেই মগধের সাথে দক্ষিণ ভারতের যোগাযোগে অন্যতম একটা বাধার কারণ হয়ে দাড়িয়েছিল। তাই দক্ষিণ ভারতের যাতায়াতের সুবিধার জন্য অশোক কলিঙ্গ অভিযান করেন।

৫. মৌর্য সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা রক্ষা : কলিঙ্গ এক সময় মগধের অধীনে ছিল। পরে তা চন্দ্রখণ্ডের আমলে স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং এক সময় তা পরাক্রান্ত রাজ্যে পরিণত হয়। এই পরাক্রান্ত কলিঙ্গ রাজ্য মৌর্য সাম্রাজ্যের জন্য বিপজ্জনক হয়ে দেখা দেয়। 

অন্যদিকে কলিঙ্গ রাজ্যও দিনের পর দিন তাদের ক্ষমতা বাড়িয়ে চলছিল। সুতরাং সম্রাট অশোক মৌর্য সাম্রাজ্যের নিরাপত্তার স্বার্থে কলিঙ্গ আক্রমণ করেন।

৬. বাণিজ্যিক কারণ : সম্রাট অশোকের সামুদ্রিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কলিঙ্গ বাধা স্বরূপ ছিল। তাই এই বাঁধা দূর করার জন্য তিনি কলিঙ্গ আক্রমণ করেন এবং যুদ্ধ সংঘটিত হয়।

৭. পিতা ও পিতামহের আদর্শ বাস্তবায়ন : অশোকের পিতা ও পিতাসহ উভয়ই ছিলেন সাম্রাজ্য বিস্তারে আগ্রহী। অশোকের পিতামহ চন্দ্রগুপ্ত সম্প্রভারতবর্ষকে একত্রিত করেন। 

সম্রাট অশোক, পিতা ও পিতামহের এ সাম্রাজ্য বিস্তারের আদর্শ গ্রহণ করে রাজ্যবিস্তারে মনোযোগী হন এবং কলিঙ্গ আক্রমণ করেন।

৮. স্থল ও সমুদ্রপথে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা : তিব্বতীয় বিবরণ থেকে জানা যায়, সম্রাট অশোক ভারতে অবাধে চলাচল করার লক্ষ্যে স্থল ও জল উভয় পথকে নিষ্কণ্টক করার জন্য কলিঙ্গ আক্রমণ করেন।

→ কলিঙ্গ যুদ্ধের ফলাফল : মৌর্য সাম্রাজ্যে রাজ্যবিস্তারের যে সূচনা হয়। অশোকের আমলে কলিঙ্গ যুদ্ধের মাধ্যমে তার সমাপ্তি ঘটে এবং এ যুদ্ধের ভয়াবহতা অশোকের মনে গভীর পরিবর্তন আনে। 

নিম্নে কলিঙ্গ যুদ্ধের ফলাফল আলোচনা করা হলো :

১. বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ : কলিঙ্গ যুদ্ধের বিভীষিকা দেখে সম্রাট অশোক খুবই মর্মস্থান হন। তিনি অনুশোচনায় দক্ষ হন এবং ধর্মান্তরিত হয়ে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন। বৌদ্ধ ধর্মের অহিংসা মন্ত্র তার মনে প্রশান্তি এনে দেয়।

২. অভ্যন্তরীণ নীতি : এ যুদ্ধের ফলে সম্রাট অশোক অভ্যন্তরীণ নীতিতে পরিবর্তন আনেন। জনসাধারণের জীবনমারেরই ইহলৌকিক ও পারলৌকিক মঙ্গল সাধন করাই তার প্রধান লক্ষ্য হয়। তিনি বিভিন্ন স্থানে কূপ খনন, বৃক্ষরোপন ও চিকিৎসালয় স্থাপন করেন।

৩. সমরনীতি ত্যাগ : কলিঙ্গ যুদ্ধের পর সম্রাট অশোক সমর্থনীতি পরিত্যাগ করেন। পূর্বের গ্রাস নীতি পরিত্যক্ত হয় এবং এর পরিবর্তন সাম্য, মৈত্রী, সামাজিক অগ্রগতি ও ধর্মপ্রচারের যুগ শুরু হয়।

৪. ধর্ম মহামাত্র নিয়োগ : কলিঙ্গ যুদ্ধের পর সম্রাট অশোক অনুশোচনা দগ্ধ হন এবং প্রায়চিত করার জন্য অহিংস ধর্ম বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন। 

এ ধর্ম গ্রহণের পর তিনি সাম্রাজ্যের সর্বত্র অহিংসা বাণী পৌঁছে দেওয়ার জন্য ধর্ম মহামাত্র নিয়োগ করেন। এদের কাজ ছিল প্রজাদের আধ্যাত্মিক ও পারলৌকিক মঙ্গলের জন্য কাজ করা।

৫. বহিঃরাষ্ট্রের নীতি পরিবর্তন : কলিঙ্গ যুদ্ধের পর অশোক বাইরের দেশের সাথে নীতির পরিবর্তন করেন। কলিঙ্গ প্রস্তর লিপিতে তিনি ঘোষণা করেন যে, অতঃপর প্রতিবেশী রাজ্যগুলোর শাসকরা যেন মৌর্য সাম্রাজ্যের সামরিক শক্তিতে ভীত না হন এবং তিনি তাদের দুঃখের কারণ না হয়ে সুখের কারণ হবেন।

৫. রাজ্যের মিত্রতা লাভ : সম্রাট অশোকের ভয়াবহ কলিঙ্গ আক্রমণ ও জয়ের অন্যতম একটি ফলাফল লাভ হয়েছিল। আর সেটি ছিল বিভিন্ন রাজ্যের সাথে মিত্রতা সৃষ্টি করা। 

অশোক ভয়াবহ কলিঙ্গ যুদ্ধের পরিণামে মর্মাহত হয়ে মৈত্রী নীতি অনুসরণ করেন। তিনি বিভিন্ন প্রতিবেশী রাষ্ট্র ও গ্রিকদের সাথে মৈত্রী সম্পর্ক স্থাপন করতে প্রবৃত্ত হন। 

মৈত্রী নীতির কারণে অশোক সুযোগ থাকা সত্ত্বেও দাক্ষিণাত্যের ঢোল, পান্ড্য, সভ্যপুর প্রভৃতি দুর্বল, রাজ্য সাম্রাজ্যভুক্ত করার কোনো উদ্যোগ নেননি। বরঞ্চ তাদের সাথে মিত্রতা করেই তিনি খুশি থাকেন।

৬. ধর্ম যাত্রার নির্দেশ : সম্রাট অশোক বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করে এ ধর্মের বাণী সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য তিনি ধর্ম যাত্রার নির্দেশ দিতেন এবং ধর্ম প্রচারকদের প্রেরণ করতেন ।

৭. জনকল্যাণমূলক কার্যাবলী : সম্রাট আশোক কলিঙ্গ যুদ্ধের পর বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কার্যাবলি গ্রহণ করেন। যেমন- প্রশস্ত রাস্তা, অতিথিশালা, মানুষ ও পশুর জন্য চিকিৎসালয় নির্মাণ প্রভৃতি কাজ করেন। মোটকথা অশোক শাসনব্যবস্থাকে মানবধর্মী ও জনকল্যাণকামী করে গড়ে তোলেন।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, সম্রাট অশোকের আমলের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলো কলিঙ্গ যুদ্ধ। এ যুদ্ধের মাধ্যমে সম্রাট অশোকের জীবনে এক বিরাট পরিবর্তন আসে। 

এ পরিবর্তনের ছোঁয়া তার শাসনব্যবস্থায় প্রভাব ফেলে ছিল তিনি কলিঙ্গ যুদ্ধের পর বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কার্যাদিও সম্পূর্ণ করে থাকেন। 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ