শশাঙ্কের শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে বর্ণনা দাও

শশাঙ্কের শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে বর্ণনা দাও
শশাঙ্কের শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে বর্ণনা দাও

শশাঙ্কের শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে বর্ণনা দাও

  • অথবা, শশাঙ্কের শাসনব্যবস্থার মূল্যায়ন কর ৷ 

উত্তর : ভূমিকা : প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে শশাঙ্কের রাজত্বকাল এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে। তাঁর শাসনামলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে শশাঙ্কের শাসনব্যবস্থা। 

৬০৬ খ্রিষ্টাব্দে শশাঙ্ক গৌড়ের সিংহাসনে আরোহণ করার পর তিনি রাজ্যের বিস্তৃতির জন্য একাধিক কৌশল অবলম্বন করেন। 

তিনি গৌড়রাজ হিসেবে গৌড়ের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখতে মালব রাজ দেবগুপ্তের সাথে চুক্তি সম্পাদন করেন। সর্বপোরি রাজ্য জয়ের পর শশাঙ্ক রাজ্যের শাসনব্যবস্থার প্রতি মনোনিবেশ করেন।

শশাঙ্কের শাসনব্যবস্থা বা শাসনপদ্ধতি : শশাঙ্ক শুধু একজন যোগ্য শাসকই ছিলেন না, তিনি একজন যোগ্য প্রশাসকও ছিলেন। শশাঙ্কের শাসনব্যবস্থা গুপ্ত বংশের অনুরূপ ছিল। 

নিচে শশাঙ্কের শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো :

১. রাজার দায়-দায়িত্ব ও কর্তব্য : শশাঙ্কের শাসনব্যবস্থায় রাজাই ছিল সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। রাজার দায়িত্ব ছিল দেশে শান্তিশৃখলা প্রতিষ্ঠা করা এবং বিদেশি শত্রুর হাত থেকে দেশকে মুক্ত রাখা।

এছাড়াও রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণ আইন প্রণয়ন যুদ্ধ পরিচালানা করাও ছিল রাজার অন্যতম দায়িত্ব। শশাঙ্ক যুদ্ধ ক্ষেত্রে নিজে উপস্থিত থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করতেন। 

তিনি যুদ্ধ ক্ষেত্রে তাঁর প্রজাদের সাহায্য নিতেন। শশাঙ্ক তাঁর রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর বিচারও করতেন।

২. রাজার ক্ষমতা : শশাঙ্ক ছিলেন গৌড় রাজ্যের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। শশাঙ্ক তাঁর শাসনব্যবস্থার অনুকূলে বিভিন্ন ধরনের আইনের প্রবর্তন করতেন। 

এ রাজা মহারাজাধিকার উপাধি গ্রহণ করতেন। শশাঙ্কের একাধিক শিলালিপিতে গৌড় কর্ণসুবর্ণরাজ শশাঙ্ক ও মহারাজাধিরাজের উপাধি গ্রহণ করেন ।

৩. বিভিন্ন রাজ কর্মচারীবৃন্দ : শশাঙ্কের শাসনব্যবস্থার অধীনে অনেক কর্মচারী নিযুক্ত ছিল। এদের মধ্যে মহাপ্রতীহার মহাপিশুপতি, পঞ্চাধিকরনোপরিক, পূর্বকোলোপরিক ও পাটুৎপরিস্ক ছিল উল্লেখযোগ্য। 

কোন বিশেষ রাষ্ট্রীয় এবং যুদ্ধ বিগ্রহ ব্যপারে নিযুক্ত উচ্চপদস্থ কর্মচারীর নাম ছিল মহাপ্রতীহার আবার রাজকীয় হস্তীবাহিনীর প্রধান শিক্ষা দান করাকে বলা হতো মহাপিলুপতি।

৪. প্রশাসনিক বিভাগসমূহ : সমসাময়িক বিভিন্ন শিলালিপি থেকে জানা যায়, রাষ্ট্রের গঠন বিন্যাস প্রশাসনিক বিভাগ ও শাসনব্যাবস্থার পরিচালনা পদ্ধতি গুপ্তযুগের মতোই ছিল। 

শশাঙ্ক তাঁর শাসনকার্যের সুবিধার জন্য বর্তমান কালের মতো তার শাসন বিভাগকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করেন। এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় বিভাগটির নাম ছিল ভুক্তি। 

ভূতিকে বর্তমানকালের প্রশাসনিক বিভাগের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। প্রত্যেক বিভাগের অধীনে যেমন কয়েকটি জেলা থাকে তেমনি ভুক্তির অধীনে থাকত কয়েকটি বিষয়। বিষয়ের অধীনে ছিল মন্ডল বাদি ও গ্রাম।

৫. মন্ত্রিপরিষদ : রাজাকে শাসনকাজ সংক্রান্ত কাজে সাহায্য সহযোগিতার জন্য শশাঙ্ক তাঁর প্রশাসনে মন্ত্রী এবং মন্ত্রিপরিষল গঠন করেছিলেন। 

বিভিন্ন শিলালিপি থেকে এ কথা জানা যায় যে, শশাঙ্কের শাসনব্যবস্থা গুপ্ত শাসনব্যবস্থার মতই ছিল। শশাঙ্কের শাসনব্যবস্থায় যে সকল মন্ত্রীর নাম পাওয়া যায়, তা হলো পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাজস্বমন্ত্রী ও বিচারমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রী ছিলেন শাসন বিভাগের সর্বোচ্চ কর্মচারী। এছাড়াও উচ্চপদস্থ কর্মচারী ও সামন্তদের নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ গঠিত ছিল। 

এ মন্ত্রিপরিষদে সামন্ত রাজাদের আবার সামন্ত থাকত এসকল সামন্তের প্রধান কাজ ছিল যুদ্ধ বিগ্রহের সময় সৈন্যবাহিনী দিয়ে এবং নিজে খুঁজে যোগ দিয়ে রাজাকে সর্বোচ্চ পরিমাণে সাহায্য করা।

৬. ভুক্তির শাসনকর্তা : শশাঙ্ক নিজেই ভুক্তির শাসনকর্তা নিয়োগ করতেন। রাজ পরিবার থেকেই সাধারণত ভুক্তির শাসনকর্তা নিয়োগ দেওয়া হতো। ভুক্তির শাসনকর্তার পদ ছিল উপরিক। 

তবে শশাঙ্কের সময়ে ভুক্তির শাসনকর্তার মর্যাদা ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছিল তাকে কখনও কখনও মহারাজও বলা হতো। যদিও গুপ্ত শাসনামলে উপরিকদের মহারাজাও বলা হতো কিন্তু শশাঙ্কের শাসনব্যবস্থার ভুক্তির শাসনকর্তাকে বলা হতো মহাপ্রতীহার। 

উপরিক মহারাজগণ আবার বিষয়গুলোর শাসনকর্তা নিয়োগ করতেন। বিষয়ের শাসনকর্তাদের বলা হতো বিষয়পতি। এছাড়াও শাসনব্যবস্থায় বাধি অধিকরণটি গঠিত হয়ে ছিল একজন বাজনায়ক, মহওর, অগ্রহারী ও খাগড়ীদের নিয়ে।

৭. অধিকরণে শাসনকর্তা : বাণির শাসনকার্য পরিচালিত হতো অধিকরণের মাধ্যমে। 'অধিকরণ' অর্থ সরকারি কার্যালয়। তবে শশাঙ্কের শাসনামলে আমরা অধিকরণ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারি না।

তবে বিভিন্ন শিলালিপির মাধ্যমে জানতে পারি যে, প্রাচীন | বাংলার স্থানীয় শাসনের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করতো এসব অধিকরণ। বিষয়ের অধিকরণে বিষয়পতি ছাড়াও চারজন অধিপতি থাকত। 

এরা হলেন নগর শ্রেষ্ঠী প্রথম স্বার্থবাহ প্রথম কুলিক ও প্রথম কায়স্থ। বণিক সম্প্রদায়ের প্রধানকে বলা হতো সার্থবাহ শিল্পী সম্প্রদায়ের প্রধানকে বলা হতো প্রথম কুলিক।

৮. বেসামরিক কর্মচারী : শশাঙ্কের শাসনব্যবস্থায় রাজ্যকে সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনা করার জন্য তিনি বিভিন্ন বেসামরিক লোকজনকে রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে বসান। এদের মধ্যে রাজ আমত্য, মহাপ্রতীহার বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

৯. শশাঙ্কের শাসনব্যবস্থার মূল্যায়ন : শশাঙ্ক শুধু একজন শক্তিশালী শাসকই ছিলেন না সাথে সাথে তিনি ছিলেন একজন দক্ষ প্রশাসক। রাষ্ট্রের শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য শশাঙ্ক তাঁর রাষ্ট্রের কাঠামোর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। 

যদিও শশাঙ্কের শাসনব্যবস্থার পুরোটাই গুপ্ত বংশের শাসনব্যবস্থার সাথে মিল আছে তথাপি সময়ের প্রয়োজনে শশাঙ্ক তার গৌড় রাজ্যে গুপ্ত বংশের অনুরূপ শাসন প্রবর্তনের মাধ্যমে নিজ কূটনৈতিক মেধার পরিচয় দিয়েছেন। 

তাই বলা যায় যে, শাসক হিসেবে শশাঙ্কের শাসন পদ্ধতি ছিল গৌড় রাজ্যের জন্য সময়োপযোগী এবং সঠিক শাসনব্যবস্থা। শশাঙ্ককে গৌড়ের সঠিক এবং উপযুক্ত প্রশাসক হিসেবে মূল্যায়ন করা যুক্তিযুক্ত।

উপসংহার : পরিশেষে একথা বলা যায় যে, যদিও শশাঙ্কের শাসনব্যবস্থা ছিল গুপ্ত বংশের অনুরূপ। তথাপি শশাঙ্ক স্বাধীন গৌড় রাজ্যে অনুরূপ শাসনব্যবস্থার প্রবর্তনের মাধ্যমে রাজ্যের শাসনব্যবস্থাকে সুদৃঢ় রাখতে সক্ষম হন। 

তবে এ কথা সত্য যে শশাঙ্কের সময়ই আমলাতন্ত্রের সূচনা হয়। যার ফলে বাংলাদেশে সামন্ততন্ত্রের সূত্রপাত হয়। যার পূর্ণতররূপ দেখতে পাওয়া যায় পাল আমলে। 

সর্বোপরি বলা যায় শশাঙ্কের শাসনব্যবস্থা ছিল সময়োপযোগী শাসনব্যবস্থা যার ফলে গৌড় রাজ্য তার অক্ষুণ্ণ ধরে রাখতে পেরেছিল শশাঙ্কের শাসনামলে ।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ