শাসক হিসেবে দেব পালের রাজত্বকাল আলোচনা কর

শাসক হিসেবে দেব পালের রাজত্বকাল আলোচনা কর
শাসক হিসেবে দেব পালের রাজত্বকাল আলোচনা কর

শাসক হিসেবে দেব পালের রাজত্বকাল আলোচনা কর

  • অথবা, দেব পাশের শাসনামলের বিস্তারিত বিবরণ সম্পর্কে যা জান লিখ।

উত্তর : ভূমিকা : দেবপাল ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের বাংলা অঞ্চলের পাল সাম্রাজ্যের সর্বাপেক্ষা শক্তিধর শাসক। তিনি ছিলেন পাল রাজবংশের তৃতীয় রাজা। 

তাঁর পিতা ছিলেন পালবংশের দ্বিতীয় রাজা ধর্মপাল। দেবপাল পরমভট্টারক, রাজাধিরাজ উপাধি ধারণ করে রাজসিংহাসনে আরোহণ করেন।

 দেবপাল অধুনা ভারতের আসাম ও উড়িষ্যা রাজ্যের ভূখণ্ড জন্ম করে সাম্রাজ্যের সীমানা প্রসারিত করেছিলেন। 

এছাড়াও তিনি তার স্বীয় বুদ্ধিমত্তা ও কৌশল প্রয়োগ করে বিজিত রাজসমূহে একটি সুষ্ঠু শাসনকাঠামো গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। 

নিম্নে প্রশ্নালোকে দেবপালের রাজত্বকাল সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা তুলে ধরা হলো-

দেবপালের রাজত্বকাল : পালবংশের সফল ও অত্যন্ত প্রতাপশালী রাজা দেবপাল ৮১০ সালে তার পিতা ধর্মপালের মৃত্যুর পর রাজসিংহাসনে আরোহণ করেন। 

তার মায়ের নাম ছিল রন্নাদেবী। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে তিনিও তার পিতার ন্যায় যোগ্যতার পরিচয় নিয়েছিলেন। তার রাজত্বকাল নিম্নরূপ-

১. একছত্র আধিপত্য বিস্তার : দেবপাল রাজ ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর নিজ আধিপত্য বিস্তারে মনোনিবেশ করেন। সম্রাট দেবপাল ছিলেন একাধারে শাসক ও আইন প্রণেতা। এক কথায়, তিনিই ছিলেন রাজ্যের সকল ক্ষমতার উৎস। 

তিনি মহারাজাধিরাজ, পরমভট্টারক ইত্যাদি উপাধি গ্রহণ করে সিংহাসনে আরোহণ করেন, যা তার একক আধিপত্য বিস্তারের মনোজবের বহিঃপ্রকাশ। মন্ত্রী, আমির-ওমরাহসহ সকলে দেবপালকে অত্যন্ত ভক্তি শ্রদ্ধা করতো। 

২. মুঙ্গের শহরে রাজধানী স্থানান্তর : ইতিহাস থেকে জানা যায় দেবপাল ছিলেন অত্যন্ত দূরদর্শী একজন শাসক। তিনি তার শাসনব্যবস্থা সুসংহত করার জন্য ধর্মপালের সময়কালীন পালবংশের রাজধানী পাটালিপুর শহর থেকে মুঙ্গের শহরে স্থাপন করেন। 

দেবপাল ব্যক্তিগতভাবেও মদের শহরের প্রতি টান অনুভব করতেন। তিনি মুঙ্গের শহরে বহু বৌদ্ধ মঠ নির্মাণ করেন। মুঙ্গের শহরকে তিনি তার সাম্রাজের শাসনব্যবস্থার কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।

৩. মন্ত্রিপরিষদ গঠন : পালবংশের তৃতীয় রাজা দেবপাল ছিলেন আদর্শ রাষ্ট্র পরিচালক। একটি বিশাল সাম্রাজ্য পরিচালনার যাবতীয় গুণ তার মাঝে বিদ্যমান ছিল। 

তিনি তার পিতামহ ও পিতা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত পাল সাম্রাজ্য রক্ষার পাশাপাশি সাম্রাজ্য সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য রাষ্ট্রের শিক্ষিত, যোগ্য ও বিশ্বাসভাজন ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি মন্ত্রিসভা গঠন করেন। 

তিনি রাষ্ট্রীয় যেকোনো সিদ্ধান্তে মন্ত্রিসভার পরামর্শ গ্রহণকরণে দর্ভপানি ও কেনার মিত্রকে প্রাধান্য দিতেন। এ দু'জন ছিলেন দেবপালের মন্ত্রীদের মাঝে অন্যতম ।

৪. ধর্মীয় পৃষ্ঠপোষকতা : দেবপাল নিজেই বৌদ্ধধর্মের অনুসারী ছিলেন। তিনি বৌদ্ধধর্মের প্রচার প্রসারে উৎসাহ প্রদান করতেন। মগধের বৌদ্ধ মঠগুলো তিনি নিজ উদ্যোগে সংস্কার করেছিলেন। 

তিনি বুদ্ধ গয়া ও নালন্দায় বেশ কয়েকটি মঠ নির্মাণ করেন। সর্বোপরি তিনি বৌদ্ধধর্মের প্রচার ও প্রসারে সবরকম সহযোগিতা করতেন। 

দেবপাল তার প্রিয় মুঙ্গের শহরে বহু বৌদ্ধ মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। এ সময় তিনি ছিলেন বৌদ্ধধর্মের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক।

৫. সৈন্য বাহিনী গঠন : একটি সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনী যত শক্তিশালী হয় সে সাম্রাজ্যও তত প্রতাপশালী সাম্রাজ্যে পরিণত হয়। দেবপাল তার রাজত্বকালে একটি পক্ষ সেনা ইউনিট গড়ে তুলেছিলেন। 

যারা বিশাল সাম্রাজ্য রক্ষা ও নতুন নতুন রাষ্ট্র বিজয়ে অনবদ্য ভূমিকা রেখেছিল। তার এ সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন তার ছোট ভাই বাকপালের পুত্র জয়পাল। ভাগলপুর তাম্রশাসনেও রাজা দেবপালের সৈন্য বাহিনীর প্রশংসা করা হয়েছে।

৬. শিক্ষা ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা : একজন পরিপূর্ণ ও দক্ষ, ধীশক্তির অধিকারী পাল সম্রাট হিসেবে দেবপাল ছিলেন অন্যতম। যার স্পষ্ট উদাহরণ হলো শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশে তার উপারতা।

তিনি রাজ্যের বিদ্যান ও পণ্ডিতদের অত্যধিক শ্রদ্ধা করতেন। দেবপালের রাজসভায় বহু বৌদ্ধ পণ্ডিত মনীষীদের সরব উপস্থিতি ছিল। 

তারই পৃষ্ঠপোষকতায় তৎকালীন সময়ে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় বৌদ্ধ শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিকাশের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল।

৭. বন্ধত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন : দেবপাল ছিলেন একজন দূরদর্শী শাসক। তিনি তার শাসনামলের অধিকাংশ সময় যুদ্ধ- বিগ্রহে ব্যস্ত থাকতেন। তথাপি তিনি দূরবর্তী রাজ্যের শাসকদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতেন। 

যার ফলে ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরেও তার সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল সুমাত্র যবদ্বীপ, মালয় উপদ্বীপের অধিপতি শৈলেন্দ্র বংশীয় মহারাজা বালপুত্রদেব দেবপালের নিকট দূত প্রেরণ করেছিলেন।

আর এমন গুণের অধিকারী হওয়ার কারণেই মূলত দেবপাল বিশাল এক সাম্রাজ্যের অধিকারী হতে সক্ষম হয়েছিলেন।

৮. সফল বিজয়াভিযান : পালবংশের তৃতীয় রাজা দেবপাল তার শাসনামলে বেশ কিছু সফল বিজয়াভিযান পরিচালনা করেছিলেন যা নিম্নরূপ

(ক) উড়িষ্যা বিজয় : দেবপাল ছিলেন একজন দক্ষ শাসক ও রাজ্য বিজেতা। ভাগলপুর ও বাদলালিপি তাম্রশাসন থেকে জানা যায় যে, দেবপাল ভারতের উড়িষ্যা বিজয় করেছিলেন। 

ঐতিহাসিক লামাতারনাথও তার গ্রন্থে এমনটি উল্লেখ করেছেন। প্রতিটি রাজাই তার পার্শ্ববর্তী রাজ্য আক্রমণ করে থাকেন। 

দেবপালও একই কাজ করেছিলেন। ধারণা করা হয় তঞ্জবংশীয় রাজা রনভঙ্গের শাসনের পরবর্তী কোনো এক সময়ে তিনি উড়িষ্যা আক্রমণ করেছিলেন।

(খ) দ্রাবিড় রাজ্য জয় : পাল রাজা দেবপালের শক্তিশালী সৈন্যদল দ্রাবিড় রাজ্যে সফল অভিযান চালায়। রাজা দেবপাল দ্রাবিড় রাজার অহংকার চূর্ণ করেছিলেন। 

তবে ঐতিহাসিক ও পণ্ডিতগণ মনে করেন রাজা দেবপাল মূলত রাষ্ট্রকূট রাজ্য আক্রমণ করেছিলেন। কেননা অতীত থেকেই পাল সাম্রাজ্যের সাথে রাষ্ট্রকূট রাজাদের শত্রুতা ছিল। 

আর দ্রাবিড় বলতে দক্ষিণ এলাকা বুঝায় না; বরং রাষ্ট্রকূট রাজ্যের অবস্থান ছিল দক্ষিণ ভারতে। তাই বহু ঐতিহাসিক দ্রাবিড় নাথ ও রাষ্ট্রকূট রাজ্যকে অভিন্ন মনে করে থাকেন।

(গ) প্রাগজ্যোতিষ বিজয় : পাল শাসক দেবপাল আসাম বা প্রাগজ্যোতিষ অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। শক্তিশালী সেনাবাহিনীর সাহায্যে দেবপাল সহজেই প্রাগজ্যোতিষ জয় করতে সক্ষম হন।

তাম্রশাসনের বিবরাণী থেকে জানা যায় দেবপাল সহজেই আসাম বা প্রাগজ্যোতিষ রাজ্যে আধিপত্য বিস্তার লাভ করতে সক্ষম হন। 

ইতিহাস থেকে জানা যায়, পাল সম্রাট দেবপালের সেনাপতি জয়পাল আত্মসম্পূর্ণ করতে বললে আসাম রাজা বিনা যুদ্ধে আত্মসম্পূর্ণ করেন।

(ঘ) হুনরাজ্য ও কম্বোজ জয় : ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রারম্ভে হুনজাতি আর্যবর্তের পশ্চিমভাগে বিস্তৃত রাজ্য স্থাপন করেছিল। কিন্তু তারা দিন দিন আর্থিক সামরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছিল। 

বাধ্য হয়ে তারা খণ্ড, খণ্ড এলাকা গঠন করে বসবাস করতে থাকে। পাল রাজা দেবপাল হুনরাজ্য জয় করেন এবং কম্বোজ পর্যন্ত অগ্রসর হন। 

মূলত হুনদের সাথে পালবংশের সীমান্ত থাকায় এবং তাদের মাঝে দ্বন্দ্বের কারণে নিরাপত্তাগণ দিক চিন্তা করে দেবপাল স্থনরাজ্য আক্রমণ করেন। পরবর্তীতে তিনি কম্বোজ রাজ্যও জয় করেছিলেন বলে, ঐতিহাসিকভাবে জানা যায় ।

৯. দেবপালের শাসনকাল : পাল রাজা ধর্মপালের ন্যায়- দেবপালের শাসনামলও বেশ দীর্ঘ ছিল। আনুমানিক ৮৩১ থেকে ৮৬১ সাল পর্যন্ত প্রায় ৩৫ বছর তিনি পাল সাম্রাজ্যে রাজত্ব করেছিলেন বলে জানা যায়। 

বাদলা শিলালিপিতে তার অধীনে গুরু মিশ্রের বংশের তিনজন ব্যক্তি মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। যারা ছিলেন ঐ বংশের তিন পুরুষের উত্তরাধিকারী; যা দেবপালের দীর্ঘ রাজত্বকালের অন্যতম প্রমাণ। শাসক হিসেবে দেবপাল যেমন দীর্ঘ সময় রাজত্ব করেছেন, তেমনি রাজ্য বিস্তারও করেছেন।

উপসংহার : আলোচনার শেষ পর্যায়ে এ কথা বলা যায় যে, গোপাল প্রতিষ্ঠিত পাল রাজবংশের অত্যন্ত শক্তিশালী ও ক্ষমতাধর রাজা ছিলেন দেবপাল। 

যার রাজনৈতিক দূরদর্শিতা এবং কৌশল ছিল অসাধারণ। তিনি পিতা ধর্মপালের যোগ্য উত্তরসূরি ছিলেন। পিতার ন্যায় তিনিও রাজ্য বিস্তারে মনোনিবেশ করেছিলেন। 

দেবপাল পাল শাসক হিসেবে সমগ্র পাল সাম্রাজ্যে শাসনতান্ত্রিক সুশৃঙ্খলা কায়েম করতে সক্ষম হয়েছিলেন। মন্ত্রিসভা ও শক্তিশালী সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে তিনি প্রতাপশালী এবং আদর্শ একটি রাষ্ট্র গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। 

যেখানে কখনও শক্ত রাজ্য বিদ্রোহ দেখা যায়নি; বরং সকলেই দেবপালকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতো। দেবপালের রাজত্বকাল ইতিহাসের পাতায় আজ স্বর্ণাক্ষরে লিখিত আছে। 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ