শিক্ষা ও সংস্কৃতির অগ্রগতিতে আলাউদ্দিন হুসেন শাহের অবদান লিখ

শিক্ষা ও সংস্কৃতির অগ্রগতিতে আলাউদ্দিন হুসেন শাহের অবদান লিখ
শিক্ষা ও সংস্কৃতির অগ্রগতিতে আলাউদ্দিন হুসেন শাহের অবদান লিখ

শিক্ষা ও সংস্কৃতির অগ্রগতিতে আলাউদ্দিন হুসেন শাহের অবদান লিখ

  • অথবা, শিক্ষা ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক হিসেবে আলাউদ্দিন হুসেন শাহের কৃতিত্ব মূল্যায়ন কর। 

উত্তর : ভূমিকা : "Husain Shah was one of the moor and parhaps the most important ruler in the history of Mediaval Bengal", অর্থাৎ 'মধ্যযুগে বাংলার ইতিহাসে হুসেন শাহ অন্যতম অথবা সম্ভবত সর্বশ্রেষ্ঠ গুরুত্বপূর্ণ শাসক ছিলেন। 

হুসেন শাহ বাংলার সিংহাসন লাভের পর একটি কল্যাণমুখী ও উনার শাসন ব্যবস্থা প্রণয়ন করেছিলেন। তিনি বাংলার শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। বাংলার শিক্ষা সাহিত্যের বিকাশে তার ভূমিকা অনন্য।

→ শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশে হুসেন শাহ : বাংলার শিক্ষা ও সংস্কৃতির চর্চা একটি নবরূপ লাভ করে হুসেন শাহের আমলে। হুসেন শাহ বাংলার শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে তোলেন। 

নিম্নে শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে হুসেন শাহের অবদান আলোচনা করা হলো :

১. শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ : হুসেন শাহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণের মাধ্যমে শিক্ষাকে এগিয়ে নেবার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি মালদহে একটি বিরাট মাদ্রাসা নির্মাণ করান। 

এ মাদ্রাসাতে প্রচুর শিক্ষার্থী একসাথে পড়াশুনা করার সুযোগ লাভ করতো। মাদ্রাসাটিতে শিক্ষার্থীদের জন্য বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা প্রদান করা হয়েছিল। 

ফলে শিক্ষার্থীরা এখানে পড়াশুনা করার উৎসাহ লাভ করে। প্রতিষ্ঠানটি হুসেন শাহের স্থাপত্য কর্মের ও উৎকর্ষের পরিচয় বহন করে।

২. মসজিদ নির্মাণ : হুসেন শাহ একজন নিষ্ঠাবান মুঘলমান ছিলেন। তিনি বহু মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। যেহেতু অনেক আগে থেকে বাংলায় মসজিদভিত্তিক শিক্ষাক্রম চালু ছিল, তাই এসব মসজিদকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যবহার করা হতো তা বলা যায়। 

হুসেন শাহ কর্তৃক নির্মিত মসজিদের মধ্যে ছোট সোনা মসজিদ অন্যতম। এছাড়া বড় সোনা মসজিদের নির্মাণ কাজ তিনি শুরু করেছিলেন বলে ধারণা করা হয়ে থাকে।

৩. পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান : হুসেন শাহ বাংলার শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশে ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করেন। হুসেন শাহ বাংলা ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রেও উৎসাহিত করেন। 

তিনি শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশে প্রচুর পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। এর ফলে বাংলা ভাষায় শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রবণতাও বেড়ে যায়।

৪. উদারতার প্রভাব : হুসেন শাহ একটি উদার শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। তার শাসক্ষেত্রে মেধার বিচারে নিয়োগ প্রদান করা হতো। এ ব্যবস্থায় মেধাবীরা মূল্যায়িত হতে থাকে। 

এতে করে মেধাবীরা শিক্ষালাভে উৎসাহী হয় এবং তাদের যোগ্য মর্যাদা লাভ করে। ফলে শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটতে থাকে।

৫. স্থানীয় সাহিত্য ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা : হুসেন শাহ সর্বপ্রথম স্থানীয় সাহিত্য ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করেন। 

তিনি স্থানীয় সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশকে ত্বরান্বিত করার জন্য তার দরবারে স্থানীয় কবি-সাহিত্যিকদের স্থান করে দেন। স্থানীয় সাহিত্যকে গুরুত্ব দেওয়ার ফলে বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতি সগৌরবে বিকশিত হতে থাকে।

৬. হিন্দু ধর্মীয় গ্রন্থের প্রতি উৎসাহ প্রদর্শন : হুসেন শাহ হিন্দু ধর্মীয় বিভিন্ন গ্রন্থ সম্পর্কে জানতে আগ্রহী ছিলেন বলে মনে হয়য়। তার সময়ে হিন্দু ধর্মীয় বিভিন্ন গ্রন্থ সংস্কৃত থেকে বাংলায় অনুদিত হতে থাকে। 

পরাগল খানের পৃষ্ঠপোষকতায় কবীন্দ্র পরমেশ্বর মহাভারতের অনুবাদ করেন। এ অনুবাদ গ্রন্থের নাম দেন 'পাণ্ডব বিজয়', এছাড়া 'মনসাবিজয়', বৈষ্ণব পদ' 'মনসা মঙ্গল, প্রভৃতি গ্রন্থ রচিত হতে থাকে।

৭. শ্রীচৈতন্যের প্রভাব : শ্রীচৈতন্য বাংলা সাহিত্য, দর্শন ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে একটি নতুন ধারার সূচনায় ভূমিকা রাখেন। শ্রীচৈতন্য বৈষ্ণব ধর্মের প্রচার করতে গিয়ে বাংলার জনজীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেন।

তার দর্শন ও ধর্মচিন্তা মানুষের চিন্তার চেতনায় ব্যাপক প্রভাব ফেলে। শ্রীচৈতন্য বলেন- “মুচি হয়ে শুচি হয়, যদি গোবিন্দ ভঙ্গে।”

তার বাণী বাংলার সাম্যবাদী চেতনাকে বিকশিত করে। হুসেন শাহ স্ত্রী চেতনাকে তার মতবাদ প্রচারে উৎসাহ যোগান। ফলে বাংলার জনজীবনের ধ্যান-ধারণায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে।

৮. মুসলিম লেখকদের ভূমিকা : বাংলার মুসলিম লেখকরাও হুসেন শাহের সময়ে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে নানা গ্রন্থ রচনা করেন। তারা এসব গ্রন্থ রচনা করেন বাংলায়। 

ফলে বাংলা ভাষার সাহিত্যকে তারা পক্ষান্তরে সমৃদ্ধ করে। এ সময়ে বাংলা ভাষায় তারা ইসলামের নানা কাহিনিকে তুলে ধরে। 

এসব গ্রন্থের মধ্যে শাহ মুহম্মদ সগীরের লেখা 'ইউসুফ জুলেখা' অন্যতম পথ প্রদর্শক হিসেবে ভূমিকা পালন করে। স্থানীয় মানুষকে ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন ঘটনার সাথে পরিচিত করানোর জন্য এসব গ্রন্থ রচিত হয়।

৯. হিন্দু ধর্মীয় সাহিত্যে মুঘলমানদের অবদান : হিন্দু ধর্মীয় বিভিন্ন সাহিত্য রচনায় পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি মুঘলমান লেখকরা হিন্দু ধর্মীয় বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কেও লিখেছিল। 

বৈষ্ণব পদাবলির রচনার ক্ষেত্রে মুঘলমানরা বিশেষ দক্ষতা দেখায়। চাঁদকাজী বাংলা সাহিত্যের পদাবলি রচনায় প্রথম উদ্যোকা হিসেবে খ্যাত। মুঘলমানরা চৈতন্যের অনেক পদাবলি সংগ্রহ করে।

১০. আরবি ও ফার্সি ভাষার পৃষ্ঠপোষকতা : হুসেন শাহ বাংলার সাথে সাথে আরবি ও ফার্সি ভাষায় সাহিত্য রচনায় উৎসাহ প্রদান করেন। হুসেন শাহকে মুহম্মদ বুদই একটি ফার্সি ভাষায় রচিত বই উৎসর্গ করেন। 

মুহম্মদ-বিন-হুজদান বখশ 'সহীহ-আন- বুখারী গ্রন্থের তিনটি খণ্ডের নকল সম্পন্ন করেন। শেখ কৃত্তন আরবি ভাষায় 'মৃগবর্তী' নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেন।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, হুসেন শাহ বাংলার শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশে গুরুত্বপর্ণ ভূমিকা পালন করেন। হুসেন শাহের ২৬ বছরের শাসনামলে বাংলার শিক্ষা ও সংস্কৃতির যে বিকাশ ঘটেছিল তা অভূতপূর্ব। 

এজন্য তার শাসন কালকে বাংলার ইতিহাসে ‘স্বর্ণযুগ' বলে অভিহিত করা হয়। তাই তার সময়কে বলা যায়, “A period that brought hapiness and prosperity over the mass people.” (অর্থাৎ এমন একটি যুগ যা সাধারণ জনগণের জন্য সুখ এবং সমৃদ্ধি আনয়ন করেছিল।) 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ