সোমপুর বিহার সম্পর্কে বিবরণ । সোমপুর বিহার সম্পর্কে টীকা লিখ

সোমপুর বিহার সম্পর্কে বিবরণ । সোমপুর বিহার সম্পর্কে টীকা লিখ
সোমপুর বিহার সম্পর্কে বিবরণ । সোমপুর বিহার সম্পর্কে টীকা লিখ

সোমপুর বিহার সম্পর্কে বিবরণ । সোমপুর বিহার সম্পর্কে টীকা লিখ

  • অথবা, সোমপুর বিহার সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা কর।

উত্তর : ভূমিকা : বাংলার ভূমিতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ বা জাতির রাজত্ব পরিচালিত হয়েছে। তাদের শাসনামলে বিভিন্ন স্থাপনা, ভাস্কর্য ধ্বংসাবশেষ স্মৃতি হিসেবে রয়ে গেছে। 

এমনই একটি নিদর্শন হলো সোমপুর বিহার, যাকে পাহাড়পুর বিহারও বলা হয়। এ বিহার বাংলার দীর্ঘকালীন পালবংশের ইতিহাসকে বহন করে। 

এখানে বৌদ্ধদের ধর্ম শিক্ষাদান কেন্দ্র ছিল। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বৌদ্ধরা এখানে ধর্মজ্ঞান অর্জন করার জন্য আসতেন। 

পালদের পতনের পর এটির ব্যবহার ধীরে ধীরে কমে যায় এবং কালের বিবর্তনে এটি ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। পরবর্তীতে এটি আবিষ্কার করে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়েছে।

১. সোমপুর বিহার পরিচিতি : সোমপুর বা পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার যা সোমপুর মহাবিহার নামে খ্যাত। বিহারটি একটি প্রাচীন বৌদ্ধবিহার। পালবংশের দ্বিতীয় রাজাশ্রী ধর্মপাল দেব (৭৮১- ৮২১) অষ্টম শতকের শেষের দিকে বা নবম শতকে এই বিহার তৈরি করেছিলেন। 

পাহাড়পুরকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বৌদ্ধবিহার বলা হয়। আয়তনে এর সাথে ভারতের নালন্দা বিহারের তুলনা করা হয়। এটি ৩০০ বছর ধরে বৌদ্ধদের ধর্মশিক্ষা দান কেন্দ্র ছিল। ১৯৮৫ সালে ইউনেস্কো এটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের স্বীকৃতি প্রদান করে ।

২. অবস্থান ও আয়তন : পুণ্ড্রবর্ধনের রাজধানী পুণ্ড্রনগর (বর্তমান মহাস্থান) এবং অপর শহর কোটিবর্ষ (বর্তমান বানগড়) এর মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত ছিল সোমপুর বিহার। 

এর ধ্বংসাবশেষটি বর্তমানে বাংলাদেশের রাজশাহী বিভাগের অন্তর্গত নওগা জেলার বদলগাছি উপজেলার পাহাড়পুর গ্রামে অবস্থিত। 

গ্রামের মধ্যে প্রায় ০.১০ বর্গ কি.মি. (১০ হেক্টর) এলাকা জু এই পুরাকীর্তিটি অবস্থিত। প্রত্নতাত্ত্বিক এই নিদর্শনটির ভূমি পরিকল্পনা চতুর্ভুজ আকৃতির। 

সমতল ভূমি থেকে প্রায় ৩০.৩০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত পাহাড়সদৃশ স্থাপনা হিসেবে এটি বিদ্যমান। স্থানীয় লোকেরা একে গোপাল চিতার পাহাড় বলে আখ্যায়িত করতো। সেই থেকেই এর নাম হয়েছে পাহাড়পুর যদিও এর প্রকৃত নাম সোমপুর বিহার।

৩. সোমপুর বিহার আবিষ্কার : ভারতীয় উপমহাদেশে ইংরেজদের আগমনের পর তারা বিভিন্ন স্থানে জরিপ কাজ চালানো শুরু করেন। এরই ধারাবাহিকতায় বুকানন হ্যামিলটন (১৮০৭-১৮১২) সালের মধ্যে পাহাড়পুর পরিদর্শন করেন। 

এটিই ছিল পাহাড়পুরে প্রথম প্রত্নতাত্ত্বিক পরিদর্শন। এরপর ১৮৭৯ সালে আলেকজান্ডার কানিংহাম এ স্থানটি পরিদর্শন করেন এবং খননের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। 

কিন্তু জমির মালিক বলিহারের তৎকালীন জমিদার তাকে বাধা দেন। তাই তিনি সামান্য কিছু অংশ খনন করে অব্যাহতি দেন। এই সময় কেন্দ্রীয় ঢিবির অংশে চারপাশে উদগত অংশবিশিষ্ট একটি বর্গাকার ইমারত আবিষ্কার করেন। 

যার দৈর্ঘ্য ছিল ২২ ফুট। অবশেষে ১৯০৪ সালে প্রত্নতাত্ত্বিক আইনের আওতায় এই স্থান ১৯১৯ সালে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষিত হয়।

৪. সোমপুর বিহারের ইতিহাস ও পটভূমি : পালবংশের রাজা ধর্মপাল অনেক নিষ্ঠাবান বৌদ্ধ ছিলেন এবং তিনিই সোমপুর বিহার প্রতিষ্ঠা করেন। নবম শতাব্দীর শেষ ভাগে গুর্জর রাজ প্রথম ভোজ ও মহেন্দ্র পাল পালবংশের বিশেষ ক্ষতি সাধন করেন। 

পরে ১০ শতাব্দীর শেষ ভাগে পালবংশীয় রাজা মহিপাল সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধার করেন ও সোমপুর বিহার মেরামত করেন। 

এরপরে আরো একবার সোমপুর বিহার ধ্বংরে সম্মুখীন হয় এবং সেন রাজাদের শাসনামলে সোমপুর রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা হারায় এবং সোমপুর বিহারের সর্বশেষ পতন শুরু হয় ১৩শ শতাব্দীর শুরুতে বখতিয়ার বিলজির বাংলা দখল করার পর থেকে। এরপর বৌদ্ধদের এই বিহার ও মন্দির সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়।

৫. সোমপুর বিহারের স্থাপত্য নিদর্শন : বৌদ্ধ বিহারটির ভূমি চতুষ্কোনাকার। এর চারিদিকে চওড়া সীমানা দেয়াল দিয়ে ঘেরা ছিল। সীমানা দেয়াল বরাবর অভ্যন্তর ভাগে সারিবদ্ধ ছোট ছোটকক্ষ ছিল উত্তর দিকে ৪৫টি এবং অন্য তিন দিকের বাহুতে ৪৪টি করে কক্ষ ছিল, যার কক্ষগুলোর মেঝেতে ইটের উপর পুরু সুরকি দিয়ে মজবুত করা ছিল। 

কক্ষগুলোর মেঝেতে দৈনন্দিন ব্যবহারযোগ্য কিছু দ্রব্যাদি পাওয়া যায়। কক্ষগুলোর সামনে টানা বারান্দা আছে। বিহারের উত্তর বাহুর মাঝ বরাবর রয়েছে প্রধান ফটক। বিহারের উত্তর বাহুর প্রবেশ পথের সামনে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত একটি পুকুর ছিল। পরে সেটা ভরাট করা হয়।

৬. কেন্দ্রীয় মন্দির : বিহারের অন্তর্বর্তী স্থানের উন্মুক্ত চতুরের মধ্যবর্তী স্থানে রয়েছে কেন্দ্রীয় মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। এখন এটি ২১ মিটার উঁচু হলেও মূল মন্দিরটি কমপক্ষে ৩০ মিটার উঁচু ছিল। তিনটি ক্রমহ্রাসমান ধাপে উর্ধ্বগামী এ মন্দিরের ভূমি পরিকল্পনা ক্রশাকার ।

৭. অন্যান্য স্থাপনাসমূহ : বিহারের মধ্যবর্তী উন্মুক্ত অঙ্গনে আরও কিছু ইমারতের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়। এর মধ্যে বেশ কিছু শনাক্ত করা যায়নি। অঙ্গনে দক্ষিণ-পূর্বাংশে ভোজনশালা ও রন্ধনশালা। এ দুটির মাঝে ইট বাঁধানো একটি নদর্মা। 

এর পাশেই কূপ। এছাড়াও রয়েছে প্রশাসনিক ভবন, নিবেদনস্তূপ, কেন্দ্রীয় মন্দিরে প্রতিকৃতি। বিহারের বাইরের স্থাপনার মধ্যে রয়েছে স্নানাগার ও শৌচাগার, গন্ধেশ্বরী মন্দির।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলার প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা হিসেবে পাহাড়পুর বা সোমপুর বিহার অন্যতম। সোমপুর বিহারের বিভিন্ন স্থানা থেকে বৌদ্ধ শাসকদের সময়ে তাদের কার্যকলাপ ও “স্থাপত্যশিল্প সম্পর্কে জানা যায়। 

সে সময়ে বৌদ্ধধর্মের প্রচার ব্যাপকভাবে সম্পন্ন হতো এসব বিহারগুলোকে কেন্দ্র করে। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান হতে বৌদ্ধধর্মের অনুসারীরা ধর্ম শিক্ষালাভের জন্য এখানে আসত। পরবর্তীতে বৌদ্ধদের শাসনের অবসান হওয়াতে এ বিহারের কার্যকারিতা স্তিমিত হয়ে পড়ে। 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ