সুলতানি আমলে বাংলার স্থাপত্য কীর্তি সম্পর্কে যা জান লিখ

সুলতানি আমলে বাংলার স্থাপত্য কীর্তি সম্পর্কে যা জান লিখ
সুলতানি আমলে বাংলার স্থাপত্য কীর্তি সম্পর্কে যা জান লিখ

সুলতানি আমলে বাংলার স্থাপত্য কীর্তি সম্পর্কে যা জান লিখ

  • অথবা, সুলতানি আমলে বাংলার স্থাপত্য কীর্তির বর্ণনা লিখ।

উত্তর : ভূমিকা : ভারতবর্ষের ইতিহাসে সুলতানি আমল ১৩৩৮ সাল হতে ১৫৩৮ সাল পর্যন্ত একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। সুলতানি আমলে স্থাপত্যশিল্প ব্যাপক প্রসার লাভ করে। 

কেননা দিল্লীর সুলতান ও প্রাদেশিক শাসকগণ স্থাপত্য শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। তাছাড়া সাম্রাজ্য বিস্তারের আশায় তারা বিভিন্ন রাজ্য জয় করে এবং বিজিত রাজ্যে মসজিদ, প্রাসাদ দরগাহ, ইত্যাদি নির্মাণ করেন যা তাদের স্থাপত্য শিল্পের পরিচয় বহন করে।

→ সুলতানি আমলে বাংলার স্থাপত্যকীর্তি : সুলতানি আমলের স্থাপত্য শিল্পের অধিকাংশই সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতায় নির্মিত হয়। নিচে সুলতানি আমলে বাংলার স্থাপত্য কীর্তির বর্ণনা দেওয়া হলো-

১. বারোনুয়ারী মসজিদ : বারোদুয়ারী মসজিদের অপর নাম ছিল 'বড় সোনা মসজিদ'। এ মসজিদের দরজা ছিল বারটি। এ মসজিদের নির্মাণ কাজ শুরু করেন হোসেন শাহ। 

১৫২৭ সালে কাজ শেষ করেন নুসরাত শাহ। এ মসজিদটি নির্মাণ করতে ইট ও পাথর ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়াও এ মসজিদের সোনালী রং এর সিলটি করা কারুকার্য ছিল।

২. আদিনা মসজিদ : ১৩৬৯ সালে আপিনা নির্মাণ করেন সিকান্দার শাহ। এ মসজিদটির দৈর্ঘ্য ৫৭৭ ফুট এবং প্রস্থ ২৮০ ফুট। 

অনেকে মনে করেন যে সিকান্দার শাহ এ মসজিদের নির্মাণ কাজ শেষ করে যেতে পারেননি। সেটি সুলতানি স্থাপত্যকলার একটি অন্যতম নিদর্শন।

৩. ছোট সোনা মসজিদ : আলাউদ্দিন হোসেন শাহের আমলে ছোট সোনা মসজিদ নির্মিত হয়। এ মসজিনটির গারে সোনালী রঙের গিলাটি করা ছিল বলে এ মসজিদের নামকরণ করা হয় ছোট সোনা মসজিদ। এ মসজিদটি গৌড়ের ফিরোজবাদ গ্রামে অবস্থিত।

৪. বাবা আদমের মসজিদ : এ মসজিদটি নির্মিত হয় ১৪৮৩ সালে মালিক কাফুর ফতেহ শাহের রাজত্বকালে। এটি ঢাকা জেলার (বর্তমান মুন্সিগঞ্জ জেলা) রামপালে অবস্থিত। 

ধারণা করা হয় এ মসজিদ দুটি মন্দিরের উপর নির্মাণ করা হয়েছিল। মাহমুদ শাহীর আমলে নির্মিত মসজিদগুলোর সাথে এ মসজিদের শিল্পকার্যে কিছু মিল পাওয়া যায়।

৫. ষাট গম্বুজ মসজিদ : সুলতানি আমলে স্থাপত্যকীর্তির সবচেয়ে বড় নিদর্শন এই ষাট গম্বুজ মসজিদ। এ মসজিদটি পনেরো শতকের মাঝামাঝি সময়ে নির্মিত হয়। এই মসজিদটি বাগেরহাটে অবস্থিত। এটি ছিল বাংলাদেশের একটি প্রসিদ্ধ মসজিদ ।

৬. কদম রসূল মসজিদ : এ মসজিদটি নির্মাণ করেন নুসরাত শাহ। তিনি ১৫৩১ সালে এ মসজিদের নির্মাণ কাজ শুরু করে। এটি বাগেরহাট জেলায় অবস্থিত। নুসরাত শাহ মহানবী (স.) এর পদচিহ্নের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য এই মসজিদটি নির্মাণ করেন।

৭. লোটন মসজিদ : লোটন মসজিদটি নির্মাণ করেন ইউসুফ শাহের প্রিয় জৈনিকা। লোটন বিবি ছিলেন ধর্মান্তরিত মুঘলমান। প্রথম জীবনে তিনি একজন নর্তকী ছিলেন। 

১৪৭৫ সালে তিনি গৌড়ের দক্ষিণ অংশে এ মসজিদটি নির্মাণ করেন এবং তার নাম অনুসারে এ মসজিদটির নাম রাখা হয় লোটন মসজিन। ভারতের এ মসজিদটির নির্মাণ শ্রেণি ছিল অতুলনীয়।

৮. একলাখী মসজিদ : জালাল উদ্দিনের শাসনামলে স্থাপত্যকীর্তির একটি অন্যতম নিদর্শন হলো একলাখী মসলিন। ধারণা করা হয় রাজা গণেশ তার বৈদিক মন্দিরের জন্য এটি নির্মাণ করেছিলেন।

পরবর্তীতে জালালউদ্দিন এটিকে মসজিদের রুপান্তরিত করেন। লোকমুখে প্রচলন আছে যে, এই মসজিদটি নির্মাণ করতে একলাখ টাকা ব্যয় হয়েছিল বলে এ মসজিদে নাম রাখা হয়ে একলাখী মসজিদ। এ মসজিদটি ছিল শিল্পকার্যের এক অন্যতম নিদর্শন ।

৯. খান জাহান আলীর সমাধি : খান জাহান আলী একজন পীর ছিলেন। তিনি খুলনা জেলায় বসতি স্থাপন করেন এবং ওইখানেই মৃত্যুবরণ করেন। 

তার নামের সাথে মিল রেখে খুলনা- জেলার বাগেরহাটে খান आহান আলী সমাধি নির্মিত হয়। সুলতানি আমলে স্থাপত্যকীর্তির দিক থেকে এটি দারুণ প্রস্তাব বিস্তার করেছিল।

১০. গিয়াস উদ্দিন আজম শাহের সমাধি : সুলতান গিয়াস উদ্দিন আজম শাহের সমাধি স্থাপত্য কীর্তির দিক থেকে এক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। এটি ঢাকা শহর হতে ১৬ মাইল দূরে অবস্থিত। 

এটি ১৪১০ সালে নির্মিত হয়। এই সমাধির পাঁচটি দরগাহ থাকায় এটাকে পাঁচ পীরের দরগাহ নামে অভিহিত করা হয়।

১১. চিকা মসজিদ : এ মসজিদটি গৌড়ে অবস্থিত। প্রচলিত কথা আছে যে, এ মসজিদের ভিতরে অনেক চিকা (বাদুর) ছিল বলে এ মসজিদের নামকরণ করা হয় চিকা মসজিদ। 

সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ ১৫০৪ সালে এ মসজিদটির নির্মাণ কাজ শুরু করেন। এ মসজিদটি দেখতে বন্দিশালার মতো মনে হয়।

১২. দাখিল দরওয়াজা : এটি মূলত আলাউদ্দিন হোসেন শাহের তোরণ বিশেষ ছিল। এটি ছিল ইষ্টক নির্মিত। দরওয়াজা ৬০ফুট উঁচু ও ৭৩ ফুট প্রশস্ত ছিল।

১৩. কোতোয়ালী দরওয়াজা : সাম্প্রতিককালে এ তোরণটি আবিষ্কৃত হয়। এটি গৌড়ে অবস্থিত। এটি নির্মাণ করেন। নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহ। 

তিনি পনেরো শতকের মাঝামাঝি সময়ে মাহাদিপুর গ্রামে এ তোরণটি নির্মাণ করেন। শিল্প কারুকার্যের নিক থেকে এ ভোরণটি একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, সুলতানি আমলে সুলতানদের উদার পৃষ্ঠপোষকতার ফলে সুলতানি স্থাপত্যকীর্তি বিশেষভাবে উন্নতি লাভ করেছিল। সুলতানি আমলে স্থাপত্যের ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলিম সংমিশ্রণ ঘটেছিল। 

আর এ সংমিশ্রণের ফলে সুলতানি যুগে স্থাপত্য একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে নিয়েছিল। এ যুগের স্থাপত্য কীর্তি দেখে আজও আমাদের নয়ন মন জুড়ায়। 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ