আধুনিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া বিশ্লেষণে এ তত্ত্বের গুরুত্ব আলোচনা কর

আধুনিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া বিশ্লেষণে এ তত্ত্বের গুরুত্ব আলোচনা কর
আধুনিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া বিশ্লেষণে এ তত্ত্বের গুরুত্ব আলোচনা কর

আধুনিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া বিশ্লেষণে এ তত্ত্বের গুরুত্ব আলোচনা কর

  • অথবা, আধুনিক রাজনৈতিক প্রত্রিয়া বিশ্লেষণে এ তত্ত্বের কার্যকারিতা বিশ্লেষণ কর।

উত্তরঃ ভূমিকা : রাজনীতি অধ্যয়নের ক্ষেত্রে গতানুগতিক পদ্ধতির সাথে এলিট তত্ত্ব বর্তমান আধুনিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা বিশ্লেষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এলিট তত্ত্বের স্বরূপ ও কার্যকারিতা অধিক স্পষ্ট হয়ে উঠে। বর্তমানে বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যবস্থা বিশ্লেষণে এলিট তত্ত্বে ক্ষমতার ধারণা বা Power elite গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। 

বলা হয় "Power is the central concept of politics." সেজন্য ক্ষমতার ভারসাম্য নির্ণয় তথা আধুনিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা আনতে এলিট তত্ত্বের ক্রিয়াকলাপ ও আচার আচরণ গুরুত্বের সাথে স্বীকৃত।

আধুনিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া বিশ্লেষণে এলিট তত্ত্বের গুরুত্ব : আধুনিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া বিশ্লষণে এলিট তত্ত্বের গুরুত্ব বিশ্লেষণ করতে হলে বিভিন্ন তাত্ত্বিকদের মতামত বিশ্লেষণ করা জরুরি।

তাঁদের বিভিন্ন আলোচনাতে আধুনিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়াতে এলিট তত্ত্ব কি প্রভাব বিস্তার করছে সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়। নিম্নে বিভিন্ন তাত্ত্বিকদের মতামত বিশ্লেষণ করা হল

প্যারেটোর মতে, “এলিট গোষ্ঠী হল সংখ্যালঘু যারা সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা হস্তগত করার গুণের অধিকারী এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে সক্ষম।" 

তিনি তাঁর The Mind and Society' গ্রন্থে বলেছেন, "So let us make a class of people who have the highest indices in their branch of activity and to that class give the name elite." 

তাঁর মতানুসারে সমাজজীবনের সকল ক্ষেত্রেই কতিপয় সেরা মানুষ থাকেন। মূলত তাদেরকেই এলিট হিসেবে অভিহিত করা হয়।

তিনি তাঁর 'The Mind and Society' গ্রন্থে এলিট তত্ত্বের আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। প্যারেটোর দৃষ্টভঙ্গি অনুসারে সমাজে দু'টি স্তর লক্ষ্য করা যায়। যথা :

১. উচ্চস্তর বা এলিট (Higher stratum or elite) এবং

২. নিম্নন্তর বা অএলিট (Lower stratum or non elite ) ।

এ উচ্চতর স্তর বা এলিটদেরই প্যারেটো তাঁর আলোচনায় মূল কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি এলিটসের আবার দু'টি শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন। যথা :

১. শাসক এলিট (Governing elite) এবং

২. অশাসক এলিট (Non-governign elite)।

অশাসক এলিট বা Non governing elite সরকারি কার্যক্রম ও শাসন পরিচালনায় জড়িত নয়। কিন্তু নিজ ক্ষেত্রে প্রভাব রয়েছে। কিন্তু শাসক এলিটরা সরকারি কার্যাবলি ও শাসনকার্যের সাথে জড়িত। 

ফলে দেখা যায় তারা সকলে আবার সমান গুণসম্পন্ন নয়। ফলে প্যারেটো গুণের উপর ভিত্তি করে এলিটদের আবার দু'টি শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন। যথা

১. বুদ্ধিমান এলিট (Cunning elite) এবং

২. সাহসী এলিট (Courage elite)।

রাজনৈতিক ব্যবস্থায় এলিট তত্ত্বের প্রয়োগ : আধুনিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় এলিট তত্ত্বের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্যারেটো এলিটদের কতিপয় গুণের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি রাজনৈতিক ব্যবস্থায় এলিট শ্রেণির দু'ধরনের গুণের কথা বলেছেন।

প্রথমত শ্রেণির গুণাবলির মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তি, বিচক্ষণতা, দক্ষতা ও পরিচালনা কৌশলের কথা বলেছেন। দ্বিতীয় শ্রেণির মধ্যে ক্ষমতা, আনুগত্য, দেশপ্রেম ও রক্ষণশীলতার কথা উল্লেখ করেছেন।

প্যারেটো তাঁর শাসক এলিটদের প্রসঙ্গে বলেছেন, একটি দেশের সাংবিধানিক রূপ যাই হোক না কেন সেদেশের অর্থনীতিকে যারা প্রভাবিত করে সাধারণত তারাই শাসক এলিটদের নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। 

তিনি উদাহরণ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথা উল্লেখ করেছেন। প্যারেটোর মতে, যুক্তরাষ্ট্রে কখনও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায় নি বরং সেখানে ধনিকতন্ত্র প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে।

তিনি আরও বলেছেন, কোন দেশের রাজনৈতিক সংগঠন যতই গণতান্ত্রিক হোক না কেন তা মূলত এলিট শ্রেণি দ্বারাই শাসিত ও পরিচালিত হয়।

এলিটের আবর্তন : এলিট তত্ত্বে প্যারেটোর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান হল তাঁর এলিট আবর্তন তত্ত্ব। তিনি এলিট আবর্তন তত্ত্বে উল্লেখ করেছেন, “এলিট গ্রুপ গতিশীল এবং সাধারণ জনগণের মধ্যে থেকে যোগ্য ব্যক্তিগণ এলিট গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। 

এলিট গ্রুপে রূপান্তর না ঘটলে রাজনৈতিক ব্যবস্থা অনিশ্চিত ও স্থিতিশীল হয়ে পড়ে এবং তা এক সময় সংকীর্ণ এলিট গ্রুপে পরিণত হয়।

Power - এলিট

Power - এলিট অ-এলিট

এলিট - অ-এলিট

Power - এলিট - Power

চিত্র : Governing elite 3 Non-governing elite দের মধ্যে ক্ষমতা (Power) আবর্তন রেখা। তবে প্যারেটো এলিট ও অ-এলিটদের মধ্যে আবর্তনে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি মনে করতেন যে একমাত্র বুদ্ধিমান (Cunning) ও সাহসী (Courage) এলিটদের মধ্যে এলিট আবর্তন সম্ভব।

আধুনিক এলিটবাদীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বিশিষ্ট আমেরিকান লেখক Harold D. Lasswell, তিনি তাঁর সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থে 'Politics who gets what, when and how,' এলিট তত্ত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। 

তিনি বলেছেন, “রাজনীতির পাঠই হচ্ছে প্রভাব ও প্রভাবশালী সম্পর্কিত পাঠ।” তিনি আরও বলেছেন, “প্রভাবশালী হচ্ছে তারা যারা যতটুকু পাওয়ার তার মধ্যে সর্বাধিক অংশটুকু পায়। যারা সর্বাধিক লাভ করে তারাই এলিট, বাকি সকলেই সাধারণ মানুষ ।"

অন্য এক আধুনিক এলিট তত্ত্ববিদ সি. রাইট মিলস্ তাঁর 'The Power Elite' গ্রন্থে এলিট তত্ত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। 

সেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন, “এলিট হচ্ছে তারা যারা বিভিন্ন সুদূরপ্রসারী সিদ্ধান্ত গ্রহণের সঙ্গে সংযুক্ত থাকেন।” তাঁর সংজ্ঞা বা এলিট ধারণার মূলভিত্তি হল প্রাতিষ্ঠানিক পদ। 

আধুনিককালে সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহে প্রচুর ক্ষমতার প্রসার ঘটেছে এবং যারা এ প্রতিষ্ঠানসমূহের শীর্ষে অবস্থান করে তারাই প্রভাবশালী ও ক্ষমতাবান। মিলস্ এর মতে, “আমেরিকাতে এ সকল ব্যক্তিরাই ক্ষমতা প্রয়োগকারী এলিট (Power elite) হিসেবে পরিচিত।

সার্বিক আলোচনা : উপরিউক্ত তাত্ত্বিকদের মত বিশ্লেষণ করে বলা যায় যে, বর্তমান অধুনা রাজনৈতিক প্রক্রিয়া বিশ্লেষণে এলিট তত্ত্বের প্রয়োগকে অস্বীকার করা যায় না। 

এর মূল কারণ বর্তমান রাজনীতির মূলসুর হচ্ছে 'Power' বা ক্ষমতা। আর এলিট তত্ত্ব ক্ষমতার বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যবস্থায় এলিট তত্ত্বের কার্যকারিতা তুলে ধরে এবং এর পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ করে।

বাংলাদেশসহ অন্যান্য তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোতে এলিট তত্ত্বের কার্যকারিতা অধিকভাবে প্রতিফলিত হয়। অধ্যাপক আশরফ ও শর্মা তাঁর 'Political Sociology' শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন, "Elite rule can exist only when an elite is united and when if self-consciously and coverly seeks to maintain its power and privileges in society."

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বর্তমান রাজনৈতিক প্রক্রিয়াতে এলিট গ্রুপ শুধুমাত্র সমাজের সাধারণ জনগণের উপর কর্তৃত্ব কায়েম করে না বরং এটি সমাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সাব এলিট গ্রুপের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখে। 

আর এসব এলিট গ্রুপ হচ্ছে সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণির এক বৃহত্তর অংশ। সেজন্য বর্তমান আধুনিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া বিশ্লেষণে এলিট শ্রেণির অস্তিত্বকে কোনভাবেই অস্বীকার করা যায় না।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ