আধুনিকীকরণ ও রাজনৈতিক উন্নয়নের মধ্যে পার্থক্য আলোচনা কর

আধুনিকীকরণ ও রাজনৈতিক উন্নয়নের মধ্যে পার্থক্য আলোচনা কর
আধুনিকীকরণ ও রাজনৈতিক উন্নয়নের মধ্যে পার্থক্য আলোচনা কর

আধুনিকীকরণ ও রাজনৈতিক উন্নয়নের মধ্যে পার্থক্য আলোচনা কর

  • অথবা, আধুনিকায়ন কী? আধুনিকায়ন ও রাজনৈতিক উন্নয়নের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় কর।

উত্তরঃ ভূমিকা : আধুনিকীকরণ সুবিন্যস্ত ও ধারাবাহিক অধ্যয়নের একটা নতুন বিষয় হিসেবে সকলের কাছে পরিচিতি লাভ করেছে। "Modernization is the time demand for the future and sustainable development of a country."

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক আধুনিকীকরণ বা আধুনিকীকরণের একটা স্রোত সকলের মধ্যে প্রবেশ করে। 

আর আধুনিকীকরণ বা আধুনিকীকরণের মাধ্যমে সম্পদের যুক্তিযুক্ত ব্যবহার সম্ভব হয়। আধুনিকীকরণের মূল লক্ষ্য হচ্ছে আধুনিক সমাজ প্রতিষ্ঠা এবং মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করা। সে হিসেবে আধুনিকায়ন ও রাজনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে একে অপরের পরিপূরক।

রাজনৈতিক উন্নয়ন ও আধুনিকীকরণের পার্থক্য : অনেক দার্শনিকের মতে, রাজনৈতিক উন্নয়ন ও রাজনৈতিক আধুনিকীকরণের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। এরা এক ও অভিন্ন। কিন্তু পুরোপুরি সত্য নয়। এদের মধ্যে যেমন সম্পর্ক বিদ্যমান তেমনি এদের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে।

১. G. A. Almond এর অভিমত : G. A. Almond রাজনৈতিক উন্নয়নের জন্য Functional specialization এবং Cultural secularization এ দু'টি উপাদানের উপস্থিতি অপরিহার্য বলে দাবি করেন। 

তাঁর মতে, আধুনিকীকরণ যদি প্রাকৃতিক এবং পরিস্থিতির উপর প্রযুক্তিগত এবং বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি নগরায়ন, শিল্পের বিকাশ, শিক্ষিতের হার বৃদ্ধি ইত্যাদি বুঝায় তাহলে তৃতীয় বিশ্বের বহু দেশেই রাজনৈতিক আধুনিকীকরণ পরিলক্ষিত হয়। 

অন্যদিকে, একটি দেশের সমাজের রাজনৈতিক উন্নয়নের মধ্যে সামাজিক বুদ্ধিবৃত্তিক, সামাজিক জনসংখ্যাগত ও অর্থনৈতিক দিক থেকে আধুনিকীকরণের প্রয়োজন। 

সুতরাং একথা স্বীকার করা যায় যে, রাজনৈতিক উন্নয়ন ও আধুনিকীকরণের মধ্যে পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও তারা অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত।

২. বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত বিকাশ : রাজনৈতিক আধুনিকীকরণ হল সনাতন সমাজ হতে আধুনিক সমাজে উত্তরণের একটি প্রক্রিয়া বিশেষ। আর এ প্রক্রিয়ার উল্লেখযোগ্য দিক হল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত, সংগঠনমূলক ও মানসিক। 

অপরদিকে, রাজনৈতিক উন্নয়ন হল রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসমূহের পৃথকীকরণ, সমতা স্থাপন ও দক্ষতার ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া ।

৩. শর্তের ক্ষেত্রে : আধুনিকীকরণের বিভিন্ন উপাদান সামনে বিদ্যমান থাকলেই যে রাজনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব তা মনে করার কোন কারণ নেই। 

অর্থাৎ আধুনিকীকরণের একটা পূর্বশর্ত হচ্ছে রাজনৈতিক আধুনিকীকরণ। তবে রাজনৈতিক উন্নয়ন ঘটলেই আধুনিকীকরণ এর পথ সুগম হয়।

৪. সর্বজনীন দিক : মানবীয় ও সর্বজনীন লক্ষ্যকে সামনে রেখে যে প্রক্রিয়ায় মানুষ প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশের উপর যুক্তিভিত্তিক নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে সক্ষম হয়, তাকেই রাজনৈতিক আধুনিকীকরণ বলে। 

অপরদিকে, একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থার যেসব কাঠামো বা প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেমন- আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ, রাজনৈতিক দল, চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী এ প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরবচ্ছিন্ন সক্রিয়তার সামর্থ্যকেই রাজনৈতিক উন্নয়ন বলে।

৫. S. P Huntington এর অভিমত : S. P. Huntington রাজনৈতিক উন্নয়ন সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তাঁর মতে, আধুনিকীকরণ রাজনৈতিক উন্নয়ন না ঘটিয়ে অবনতিও ঘটাতে পারে। তিনি রাজনৈতিক উন্নয়ন বলতে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান সৃষ্টিকে বুঝিয়েছেন। 

তিনি বলেছেন, আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়ায় প্রাথমিকভাবে বিপর্যয় আসতে পারে এবং তা অনেকটা রাজনৈতিক উন্নয়ন ও রাজনৈতিক সম্ভাবনা দূর করার একটি উপায় হিসেবে পরামর্শ দিয়েছেন। কাজেই এদিক থেকে চিন্তা করলে রাজনৈতিক উন্নয়ন ও রাজনৈতিক আধুনিকীকরণ এক ব্যাপার নয়।

৬. দক্ষতার বিষয় : রাজনৈতিক আধুনিকীকরণ হল এমন একটি প্রক্রিয়া যা প্রাপ্ত সম্পদের যথাযথ ও যৌক্তিক ব্যবহার নিশ্চিত করে। 

অপরদিকে, রাজনৈতিক উন্নয়ন হল রাজনৈতিক ব্যবস্থার কাঠামোসমূহের স্বতন্ত্রীকরণ, সমতা স্থাপন ও দক্ষতার এমন এক ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া যার মাধ্যমে একটি জাতি গঠন নিশ্চিত হয়।

৭. অধ্যাপক Gustave এর অভিমত : প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী Gustave রাজনৈতিক আধুনিকীকরণ ও রাজনৈতিক উন্নয়ন সম্পর্কে বলেছেন, “ঐতিহ্যকে পরিবর্তনের সাথে খাপখাইয়ে নেয়া হচ্ছে আধুনিকীকরণের শর্ত। আর কিভাবে বিচ্ছেদ সাধন করা যায় তা হচ্ছে উন্নয়নের শর্ত।"

৮. C. E. Black এর অভিমত : C. E. Black তাঁর The Dynamics of Modernization' গ্রন্থে বলেছেন, “রাজনৈতিক আধুনিকীকরণ সবসময় সুফল বয়ে আনে না। আধুনিকীকরণের ফলে অনেক সময় সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী, দল ও গোত্রের মধ্যে ঐক্যের সংকট সৃষ্টি হয়। 

আর এ সংকট নিরসন একমাত্র রাজনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমেই সম্ভব হয় তাই রাজনৈতিক আধুনিকীকরণ ও রাজনৈতিক উন্নয়ন এক ও অভিন্ন বিষয় নয়।

৯. অধ্যাপক ক্লদই ওয়েলস এর অভিমত : দই ওয়েলস আধুনিকীকরণ ও উন্নয়নের পার্থক্য সম্পর্কে বলেছেন, “আধুনিকীকরণ হচ্ছে এমন এক প্রক্রিয়া যা প্রাপ্ত সম্পদাবলির যুক্তিযুক্ত সদ্ব্যবহার ঘটায়। অন্যদিকে, রাজনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্য হচ্ছে আধুনিক সমাজ গড়ে তোলা।”

১০. নির্ভরশীলতার ক্ষেত্রে : রাজনৈতিক আধুনিকীকরণ রাজনৈতিক উন্নয়নের একটি অপরিহার্য শর্ত বা উপাদান। যেসব উপাদানের উপর রাজনৈতিক উন্নয়ন নির্ভরশীল রাজনৈতিক আধুনিকীকরণ রাজনৈতিক উন্নয়নকে পূর্ণতা প্রদান করে অর্থাৎ রাজনৈতিক আধুনিকীকরণ ছাড়া রাজনৈতিক উন্নয়ন অসম্পূর্ণ থেকে যায়। 

কিন্তু তাই বলে রাজনৈতিক আধুনিকীকরণ রাজনৈতিক উন্নয়ন নয়। এটা রাজনৈতিক উন্নয়নের অপরিহার্য শর্তসমূহের একটিমাত্র, যা রাজনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করে। 

মোটকথা বলা যায়, রাজনৈতিক আধুনিকীকরণ রাজনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার অন্যতম উপায়বিশেষ।

১১. সামাজিক পরিবর্তনশীলতার ক্ষেত্রে : রাজনৈতিক আধুনিকীকরণের ক্ষেত্রে সামাজিক পরিবর্তশীলতা একান্ত অপরিহার্য এবং অন্যতম পূর্বশর্ত। 

এক্ষেত্রে আধুনিকায়নের জন্যও সামাজিক পরিবর্তনশীলতা জরুরি। অর্থাৎ রাজনৈতিক উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন মূলত এখানে একই অর্থে ব্যবহৃত হয়।

১২. প্রত্রিয়াগত : আধুনিকায়ন হল সনাতন সমাজ হতে আধুনিক সমাজে উত্তরণের একটি প্রক্রিয়া। অন্যদিকে, রাজনৈতিক উন্নয়ন হল রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসমূহের স্বতন্ত্রীকরণ।

১৩. ধারণাগত : ধারণাগত দিক থেকে বলা যায়, আধুনিকায়ন রাজনৈতিক উন্নয়ন না ঘটিয়ে অবনতি ঘটাতে পারে। প্রাথমিক পর্যায়ে আধুনিকীকরণে বিপর্যয় আসতে পারে। অপরদিকে, ধারণাগত দিক থেকে রাজনৈতিক উন্নয়ন ও রাজনৈতিক আধুনিকীকরণ ভিন্ন বিষয়।

১৪. উপাদান এর ক্ষেত্রে : আধুনিকীকরণের ক্ষেত্রে অনেক উপাদান একত্রে সন্নিবেশিত হয়ে সম্মিলিতভাবে কাজ করে। কিন্তু রাজনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা মুখ্য বিষয়।

উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, রাজনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে একটা সামগ্রিক ধারণা এবং আধুনিকায়ন এর ক্ষেত্র বা পরিসর এর থেকে অধিক বিস্তৃত। 

তবে আধুনিকায়ন ও রাজনৈতিক উন্নয়ন দু'টি একই বিষয় হলেও বিষয়গত ও পরিধিগত দিক থেকে কিছুটা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। তবে সার্বিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে উভয়ের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ । 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ