একটি আধুনিক সমাজব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা কর

একটি আধুনিক সমাজব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা কর
একটি আধুনিক সমাজব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা কর

একটি আধুনিক সমাজব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা কর

  • অথবা, আধুনিকীকরণের প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা কর।

উত্তর : ভূমিকা : আধুনিক থেকে আধুনিকীকরণ শব্দের উৎপত্তি। আজকের যে আধুনিক সমাজ তা একদিনে আজকের পর্যায়ে 'আসে নি। 

তা কালের বিবর্তনের সাথে ঢেউ খেলতে খেলতে সনাতন সমাজের পথ মাড়িয়ে আজকের পর্যায়ে পৌঁছেছে। এ সমাজ গতানুগতিক সমাজের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। 

এখানে পুরাতন ধ্যানধারণা ও রীতির কোন স্থান নেই বললেই চলে । তাই এটি আধুনিক সমাজ। আর যে প্রক্রিয়ায় সমাজ আজকের পর্যায়ে পৌঁছেছে, তাই আধুনিকীকরণ। কারণ এ সমাজের রয়েছে গতি, রয়েছে সীমাহীন পথ চলার উন্মুল বাসনা ।

আধুনিক সমাজের বৈশিষ্ট্য (Characteristics of modern society) : কালের আবর্তে সনাতন সমাজ তার বৈশিষ্ট্য হারিয়ে সমাজ নামক নামটি ভুলতে বসেছেন। 

অন্যদিকে, আধুনিক সমাজ নতুন নতুন বৈশিষ্ট্য বুকে ধারণ করে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে। নিম্নে আধুনিক সমাজের বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরা হল :

১. শিল্পায়ন (Industrialization) : শিল্পায়ন আধুনিক সমাজের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। Prof. F. X. Shutton আধুনিক সমাজকে ‘শিল্পভিত্তিক সমাজ' বলে আখ্যায়িত করেছেন। শিল্পভিত্তিক সমাজের মধ্যে আমরা চারটি বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাই। যথা :

ক. বিশ্বজনীন মূল্যবোধ,

খ. ব্যাপক সামাজিক গতিশীলতা,

গ. উদারতা এবং

ঘ. উন্নত পেশাভিত্তিক সংঘের আধিক্য।

ক. বিশ্বজনীন মূল্যবোধ (Universal values) : এটি আধুনিক সমাজের একটি অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। দিনে দিনে মানুষ সনাতন সমাজের মুখোশ ঝেড়ে ফেলে আধুনিকতার দিকে পা বাড়ায়। 

মানুষ ব্যক্তিকেন্দ্রিক থেকে বিশ্বকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে। মানুষের ধ্যানধারণার আমূল পরিবর্তন ঘটে, মানুষ হয় আধুনিক। আর আধুনিক মানুষই ক্রমশ গড়ে তোলে আধুনিক সমাজ ।

খ. ব্যাপক সামাজিক গতিশীলতা (Vast social mobility) : সনাতন সমাজ ছিল স্থিতিশীল। সে স্থিতিশীল সমাজ ক্রমশ হয়ে পড়ে গতিশীল। মানুষের চিন্তাচেতনা, ধ্যানধারণার সর্বক্ষেত্রে আধুনিকতার ছোঁয়া পেয়ে বসে। 

এমতাবস্থায় মানুষ আধুনিক জীবনের স্বাদ উপভোগ করতে থাকে। ফলে তারা ক্রমশ আধুনিক হয়ে আধুনিক সমাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে।

গ. উদারতা (Liberality) : আধুনিক যুগ সাম্য মৈত্রী ও স্বাধীনতার যুগ। আর এটা সম্ভব হয়েছে মানুষের মানসিক উদারতার কারণে। 

আর এ উদারতা আসে মূলত মানুষের নতুন নতুন ক্ষেত্র সৃষ্টির ফসল পাওয়ার পর। তাই আমরা বলতে পারি, উদারতা আধুনিক সমাজব্যবস্থার একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

ঘ. উন্নত পেশাভিত্তিক সংঘের আধিক্য (Priority of developed professional association) : সনাতন সমাজ থেকে বেরিয়ে আসার পর মানুষ তাদের নিজস্ব প্রয়োজনে উন্নয়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের পেশাভিত্তিক সংঘ গড়ে তোলে। 

যে সংগঠনের ধ্যানধারণা বিশ্বজনীন। এর ফলে মানুষ ক্রমশ পুরো পৃথিবীর সাথে এক হয়ে পড়ে। ফলে গড়ে উঠে আধুনিক সমাজ।

২. নগরায়ন (Urbanization) : এটি আধুনিক সমাজ প্রতিষ্ঠার মূলভিত্তি। এ ভিত্তি মানুষকে ক্রমশ শহরকেন্দ্রিক করে তোলে। আর নগর হল সামাজিক পরিবর্তনের সূতিকাগার। 

ফলে এখানে মানুষ নতুন নতুন ধারা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে উঠে। আর তারই ফলশ্রুতিতে তারা আধুনিক সমাজ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়।

৩. অর্থনৈতিক উন্নয়ন (Economic development) : অর্থনৈতিক উন্নয়ন রাজনৈতিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত। আর রাজনৈতিক উন্নয়ন সামাজিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত। 

আমরা জানি, সামাজিক উন্নয়ন তথা সামাজিক পরিবর্তনের মাধ্যমে সনাতন সমাজ আধুনিকতার দিকে পা বাড়িয়েছে। কারণ অর্থনৈতিক সচ্ছলতা মানুষকে বিভিন্ন কাজে উৎসাহ যোগায়। 

আর অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল হলে মানুষ হয়ে পড়ে নিস্তেজ, অসাড়। তাই বলা যায়, অর্থনৈতিক উন্নয়ন আধুনিক সমাজের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য ।

৪. রাজনৈতিক উন্নয়ন (Political development) : রাজনৈতিক উন্নয়ন অর্থনৈতিক উন্নয়নের নিকট দায়ী। যেখানে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে, সেখানে রাজনৈতিক উন্নয়ন অবশ্যম্ভাবী। 

আর এ রাজনৈতিক উন্নয়ন মানুষের মাঝে গতির সঞ্চার করে যার ফলে মানুষ জরাজীর্ণ সমাজ তথা সনাতন সমাজকে ঘৃণা করতে শিখে। 

আর অন্যদিকে, আধুনিক সমাজের ভিত প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী হয়। তাই বলা যায়, রাজনৈতিক উন্নয়ন আধুনিক সমাজের একটি অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ।

৫. গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ (Democratic values) : আধুনিক বিশ্ব গণতান্ত্রিক বিশ্ব। হিটলার, মুসোলিনী, ফ্রাংকো যে শাসনব্যবস্থাকে ভীরু বা কাপুরুষদের শাসন বলে আখ্যায়িত করেছেন, সে গণতন্ত্র আজ উজ্জীবিত। 

চারদিকে এর জয়জয়কার ধ্বনি। কারণ গণতন্ত্রের মাঝে মানুষ প্রকৃত সুখের সন্ধান পেয়েছে। তাই বলা যায়, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ আধুনিক সমাজকে আজকের পর্যায়ে নিয়ে আসার জন্য অনেকাংশ দায়ী ।

৬. ধর্মনিরপেক্ষতা (Secularity) : এটি আধুনিক সমাজব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। আধুনিক যুগ ধর্ম নিরপেক্ষতার যুগ। 

এক সময় মানুষ ধর্মের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে সনাতন সমাজ প্রতিষ্ঠা করে, যা ছিল হীন বা নিচু মনমানসিকতার সমাজ যা মানুষকে কখনই সুখের প্রকৃত সন্ধান দিতে পারে নি।

কিন্তু আজকের সমাজ ধর্মের বেড়াজালে আবদ্ধ নয়। তারা ধর্মকে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে দেখে আধুনিক সমাজকে কলংকমুক্ত করেছে।

৭. শিক্ষার প্রসার (Expansion of education) : শিক্ষা ছাড়া কোন জাতি মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না। কারণ শিক্ষা মানুষের পঞ্চইন্দ্রিয় খুলে দেয়। সনাতন সমাজব্যবস্থায় এ শিক্ষা ছিল ঘরকুনো। 

ফলে সেখানে শিক্ষার প্রসার ঘটতে পারে নি। তাই মানুষ অনুভূতি বা স্পৃহা থাকা সত্ত্বেও নিজেদের সতেজ করে তুলতে পারে না। 

আর আধুনিক সমাজব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে তার ব্যতিক্রম। কারণ সমাজের আনাচে কানাচে শিক্ষার আলো পৌঁছেছে। 

তার ফলশ্রুতিতে সামাজিক পরিবর্তন ঘটেছে ব্যাপক হারে। তাই বলা যায়, শিক্ষার প্রসার আধুনিক সমাজের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য।

৮. যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন (Development of communication) : যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন আধুনিক সমাজব্যবস্থার দ্বার খুলে দিয়েছে। কারণ উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা মানুষের চোখমুখ খুলে দেয়।

এতে করে মানুষের জীবনে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উন্নয়ন ঘটে। ফলে সমায়া হয়ে পড়ে ক্রমবর্ধমান। আর এর ফলেই জন্ম নেয় আধুনিক সমাজের।

৯. জাতীয়তাবাদ (Nationalism) : শক্ত জাতীয়তাবাদের সমন্বয়ে সনাতন সমাজ ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে পড়েছে। আর এর স্থলে জন্ম নিয়েছে আধুনিক সমাজের, যা আজকের বিশ্বে স্থায়ীভাবে স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছে।

১০. স্থায়িত্ব (Stability) : সনাতন সমাজ যেমন ভঙ্গুর, তেমনি আধুনিক সমাজ স্থায়ী। এর কারণ হল রাষ্ট্র যতদিন থাকবে এ সমাজ ততদিন স্থায়ী হবে। তাই এ সমাজের মেয়াদ দীর্ঘদিনের। 

দীর্ঘমেয়াদি সমাজ দিনের পর দিন উন্নতির দিকে ধাবিত হয়, প্রসারিত হয় এর ডালপালা। তাই বলা যায়, স্থায়িত্ব আধুনিক সমাজকে আজকের পর্যায়ে নিয়ে এসেছে।

১১. সুদক্ষ আমলাতন্ত্র (Efficient bureaucracy) : বর্তমান বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই আমলাতন্ত্র বিদ্যমান। আমলারা তাদের কাজেকর্মে সদা পারদর্শী। 

তারা উচ্চ শিক্ষিত। তারা জানে কোন ধরনের পরিকল্পনা দেশের জন্য মঙ্গল তথা উন্নয়ন বয়ে আনবে। 

ঐ অনুপাতেই তারা দেশের জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করে থাকে। এর ফলে আধুনিক সমাজ কোন ধরনের সংকটের মুখে পড়লেও তা সাথে সাথে দূর করা সম্ভব হয়।

১২. উন্নত প্রচার মাধ্যম (Developed publicity media) : আজকের বিশ্বের প্রচার মাধ্যমের দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করলে আমাদের অবাক হতে হয় এ কারণে যে, সনাতন সমাজের মানুষ কিভাবে তাদের জীবনধারা অক্ষুণ্ণ রেখেছে। 

কারণ আজকের প্রচার মাধ্যম খুবই উন্নত যার ফলশ্রুতিতে আধুনিক সমাজ প্রতিষ্ঠার কোন ধরনের সমস্যা পোহাতে হয় না।

১৩. শিল্পায়ন : আধুনিকীকরণের অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে শিল্পের প্রসার। সেজন্য শিল্পায়ন হচ্ছে আধুনিক সমাজব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য । আর শিল্পায়ন না ঘটলে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আধুনিকীকরণ সম্ভব হয় না।

উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, আধুনিক সমাজ তার আপন মহিমায় উজ্জ্বল, যা কোন সামাজিক ঝড় বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারবে। 

তবে আধুনিক সমাজব্যবস্থা শিল্পায়ন ও প্রযুক্তিগত বিকাশের ফলে মানুষের জীবনযাত্রার মান পূর্বের তুলনায় অনেক উন্নততর হয়েছে এবং এ উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ভবিষ্যতেও বজায় থাকবে। যে কারণে আধুনিক সমাজের কর্মপরিধি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ