সনাতন ও আধুনিক সমাজের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ কর

সনাতন ও আধুনিক সমাজের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ কর
সনাতন ও আধুনিক সমাজের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ কর

সনাতন ও আধুনিক সমাজের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ কর

  • অথবা, আধুনিক ও গতানুগতিক সমাজের মধ্যে পার্থক্য দাও ।

উত্তর : ভূমিকা : আধুনিক থেকে আধুনিকীকরণ শব্দের উৎপত্তি। আজকের যে আধুনিক সমাজ তা একদিনে আজকের পর্যায়ে আসে নি। 

তা কালের বিবর্তনের সাথে ঢেউ খেলতে খেলতে সনাতন সমাজের পথ মাড়িয়ে আজকের পর্যায়ে পৌঁছেছে। এ সমাজ গতানুগতিক সমাজের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। 

এখানে পুরাতন ধ্যানধারণা ও রীতির কোন স্থান নেই বললেই চলে। তাই এটি আধুনিক সমাজ। আর যে প্রক্রিয়ায় সমাজ আজকের পর্যায়ে পৌঁছেছে, তাই আধুনিকীকরণ । কারণ এ সমাজের রয়েছে গতি, রয়েছে সীমাহীন পথ চলার উন্মুল বাসনা।

সনাতন ও আধুনিক সমাজের মধ্যে পার্থক্য : সনাতন ও আধুনিক সমাজব্যবস্থার কিছু নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও উপাদান রয়েছে । যার মাধ্যমে প্রত্যেক সমাজব্যবস্থাকে পৃথক পৃথকভাবে চিহ্নিত করা যায়। 

নিম্নে তিনটি সমাজব্যবস্থার তুলনা আলোচনা করা হল : 

১. সংজ্ঞাগত আলোচনা :

সনাতন সমাজব্যবস্থা (Traditional social system) : সনাতন সমাজ হল সেই সমাজব্যবস্থা যেখানে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগে নি এবং যে সমাজব্যবস্থার পুরোটাই অবৈজ্ঞানিকভাবে পরিচালিত।

সমাজবিজ্ঞানী Edward Shils, "These traditional societies have almost always been agricultural societies, impoverished by contemporary standards of material well being, employing traditional techniques of cultivation." 

অর্থাৎ, সনাতন সমাজ সবসময়ই কৃষিপ্রধান সমাজ, সাম্প্রতিক কালের আর্থিক সচ্ছলতার মানদণ্ডের বিচারে এরা দরিদ্র এবং এদের চাষাবাদের কৌশলও সেকেলে।

হেজেন ই. ই. (Hegen E. E) বলেছেন, "A society is traditional if behaviour is government by custom and if ways of behaviour continue with little change from generation to generation."

আধুনিক সমাজব্যবস্থা : যে সমাজব্যবস্থায় উন্নত প্রযুক্তির প্রসারতা তথা সম্পূর্ণ বিজ্ঞানভিত্তিক সমাজের উপর প্রতিষ্ঠিত সেই সমাজব্যবস্থা হচ্ছে আধুনিক সমাজব্যবস্থা। 

(Encyclopedia of Social Science) এ বলা হয়েছে, "Modernization is the social change whereby less developed societies acquire characteristics common to more develop countries.) রূপান্তরশীল সমাজও কৃষিনির্ভর। তবে এখানে আধুনিক শিল্পায়নের ব্যাপক প্রসারতা প্রক্রিয়াধীন।

২. সমাজব্যবস্থা (Social system) : সনাতন সমাজব্যবস্থা প্রথাভিত্তিক বিভিন্ন Social political কর্মকাণ্ড প্রতিষ্ঠিত ও প্রচলিত প্রথার ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। 

আধুনিক সমাজব্যবস্থাতে বহুমুখী সমাজের প্রভাব থাকলেও তা জোরদার নয়। তাই এখানে সংস্কৃতির অভাব দেখা দেয় না।

৩. মূল্যবোধ (Values) : সনাতন সমাজব্যবস্থাতে যুক্তির পরিবর্তে ভাগাকে প্রাধান্য দেয়া হয়। এই সমাজব্যবস্থাতে জনগণ অভিযাত্রায় ভাগ্য বিশ্বাসী, ধর্মীয় বিশ্বাস সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করে। 

আধুনিক সমাজব্যবস্থাতে উন্নত মানসিকতার প্রভাবে ধর্মনিরপেক্ষ ও আধুনিক মূল্যবোধ বিদ্যমান। ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি ইতিবাচক দিক হিসেবে বিবেচিত।

৪. সামাজিক মর্যাদা (Social status) : সনাতন সমাজব্যবস্থাতে সামাজিক সম্পর্ক মর্যাদা নির্ভরশীলতা বংশানুক্রমিকভাবে স্থিরীকৃত হয়। আধুনিক সমাজব্যবস্থাতে সামাজিক মর্যাদা হিসেবে বংশানুক্রমিক ব্যাঃজ্যেষ্ঠতা বিবেচনা করা হয় না। এখানে মেধা ও জ্ঞানের ভিত্তিতে সামাজিক মর্যাদা নির্ণয় করা হয়।

৫. উদারতা (Liberalism) : সনাতন সমাজব্যবস্থাতে উদারতার বিষয়টি উপেক্ষিত। এখানে সংরক্ষণবাদী মানসিকতার প্রভাব বেশি। আধুনিক সমাজব্যবস্থা সর্বদা উদারতার পক্ষে কথা বলে। এখানে সংরক্ষণবাদী মানসিকতাকে প্রশ্রয় দেয়া হয় না।

৬. পরিবর্তন (Change) : সনাতন সমাজব্যবস্থা পরিবর্তন বিমুখ, এখানে পরিবর্তনের বিষয়ে সচেতন ও ইচ্ছাবোধ জাগ্রত হয় না। আধুনিক সমাজব্যবস্থা গতিশীল ও পরিবর্তনশীলতায় বিশ্বাসী। সময়ের চাহিদার সাথে সামজস্য রেখে সব ধরনের পরিবর্তন ঘটে থাকে।

৭. গতিশীলতা (Mobility) : সনাতন সমাজব্যবস্থা গুরায়িত, আবদ্ধ সমাজব্যবস্থা। এ সমাজে সামাজিক গতিশীলতা নেই বললেই চলে। আধুনিক সমাজব্যবস্থাতে Social mobility বা সামাজিক গতিশীলতা অনেক বেশি গতিবান।

৮. শিল্পায়ন (Industrialization) : সনাতন সমাজব্যবস্থাতে শিল্প ছিল কুটির শিল্প, সনাতন কুটির শিল্প ছিল মানব শ্রমনির্ভর। আধুনিক সমাজব্যবস্থাতে উন্নত প্রযুক্তি ও দক্ষতা এবং অবাধ পুঁজির জন্য শিল্পায়নের প্রসারতা বেগবান। 

৯. নেতৃত্ব (Leadership) : সনাতন সমাজব্যবস্থাতে সুষ্ঠু দক্ষ নেতৃত্বের দ্বারা রাষ্ট্র ও সমাজ পরিচালনার বিষয়টি প্রায় অনুপস্থিত বলা যায়। আধুনিক সমাজব্যবস্থাতে দক্ষতার সাথে রাষ্ট্র, সমাজ ও প্রশাসন পরিচালনার জন্য উন্নত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ নেতৃত্ব গড়ে তোলা হয়।

১০. বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি (Scientific views ) : সনাতন সমাজব্যবস্থাতে আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক চিন্তাচেতনার বিষয়টি সম্পূর্ণ অনুপস্থিত থাকে। 

আধুনিক সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠে মূলত বৈজ্ঞানিক চিন্তাচেতনাকে অবলম্বন করে। তাই এই সমাজব্যবস্থাতে নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও এলিট শ্রেণি সকলেই বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের চর্চায় লিপ্ত ।

১১. গণমাধ্যম (Mass media) : সনাতন সমাজব্যবস্থাতে গণমাধ্যম সম্পূর্ণরূপে সরকার ও একটি নির্দিষ্ট সামাজিক গোষ্ঠী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আধুনিক সমাজব্যবস্থাতে গণমাধ্যমগুলো পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসনের সুবিধা ভোগ করে। এই সমাজব্যবস্থাতে গণমাধ্যমগুলোর উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয় না।

১২. নগরায়ন (Urbanization) : সনাতন সমাজব্যবস্থাতে নগরায়নের বিষয়টি অনুপস্থিত। এখানে গ্রামীণ জীবনযাত্রার প্রতি আকৃষ্টতা বেশি। আধুনিক সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠে নগরকে কেন্দ্র করে।

এখানে 'অসম নগরায়নের বিষয়টি অনুপস্থিত। এখানে পূর্ণাঙ্গ আধুনিকতা অর্জনের জন্য গ্রাম ও নগরে সমান উন্নয়ন ঘটানো হয়।

১৩. পরিবর্তনশীলতা : সনাতন সমাজ পরিবর্তনবিমুখ, এখানে পরিবর্তনের বিষয়ে সচেতনতা ও ইচ্ছাবোধ জাগ্রত হয় না। আধুনিক সমাজব্যবস্থাতে Social mobility বা সামাজিক গতিশীলতা সত্য ও গতিবান।

১৪. গণমাধ্যমের ভূমিকা : সনাতন সমাজব্যবস্থাতে গণমাধ্যমের অস্তিত্ব তেমন ছিল না বললেই চলে। অর্থাৎ গণমাধ্যম সনাতন সমাজব্যবস্থায় রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক কোন ক্ষেত্রেই হস্তক্ষেপ করত না। আধুনিক সমাজব্যবস্থাতে গণমাধ্যমগুলো পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসনের সুবিধা ভোগ করে।

১৫. গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ : সনাতন সমাজব্যবস্থাতে গণতান্ত্রিক আচার আচরণের অস্তিত্ব দেখা যায় না বললেই চলে । অর্থাৎ গণতন্ত্রের বিকাশ সনাতন সমাজে খুব একটা বিকশিত হয় নি। 

আধুনিক সমাজব্যবস্থাতে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ অনেক বেশি। এখানে অতীতের ঐতিহ্যকে আঁকড়ে থাকা হয় না।

উপসহোর : উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সনাতন ও আধুনিক সমাজকাঠামোতে ব্যাপক ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। 

তবে আধুনিক সমাজকাঠামোতে সর্বক্ষেত্রে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগলেও মানুষের মধ্যে পারস্পরিক আন্তরিকতার অভাব এখানে সুস্পষ্ট। 

কিন্তু সনাতন সমাজকাঠামাতে মানুষের মধ্যে আন্তরিকতার কোন অভাব ছিল না। সুতরাং সনাতন ও আধুনিক সমাজ দু'টি ভিন্ন ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে গড়ে উঠেছিল। 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ