এলিট তত্ত্বের গুরুত্ব ও সীমাবদ্ধতা বিশ্লেষণ কর

এলিট তত্ত্বের গুরুত্ব ও সীমাবদ্ধতা বিশ্লেষণ কর
এলিট তত্ত্বের গুরুত্ব ও সীমাবদ্ধতা বিশ্লেষণ কর

এলিট তত্ত্বের গুরুত্ব ও সীমাবদ্ধতা বিশ্লেষণ কর

  • অথবা, এলিট তত্ত্ব কী? এ তত্ত্বের প্রয়োজনীয়তা ও সীমাবদ্ধতা আলোচনা কর।

উত্তর : ভূমিকা : বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থা বিশ্লেষণে গণতান্ত্রিক ও অন্যান্য মতাবলম্বী রাষ্ট্রের কার্যাবলি বিশ্লেষণে এলিট তত্ত্ব এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। 

এলিট তত্ত্বের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে সমাজের প্রধান দু'টি শ্রেণি 'Governing class' শাসক শ্রেণি ও 'Non-governing class অশাসক শ্রেণির কার্যাবলি বিশ্লেষণ করা। 

এলিট তত্ত্বের আলোচনায় কতিপয় শাসক শ্রেণি বা মুষ্টিমেয় গোষ্ঠীর অস্তিত্বকে অধিক গুরুত্বের সাথে দেখা হয়। এ তত্ত্বের এ এক শ্রেণির গুরুত্বের কারণে বিভিন্ন রাজনৈতিক বিশ্লেষক এ তত্ত্বের বিভিন্ন সমালোচনা করেছেন। 

এলিট তত্ত্বের মূল পুরোধা হিসেবে গণ্য করা হয় Vilfredo Pareto কে। তিনি তাঁর সুবিখ্যাত গ্রন্থ The Mind and Society' গ্রন্থে এলিট তত্ত্বের গুরুত্বকে পূর্ণাঙ্গভাবে বিশ্লেষণ করেছেন।

এলিট তত্ত্ব (Elite theory) : আভিধানিক অর্থে এলিটবাদ বলতে উৎকৃষ্ট শ্রেণির মুষ্টিমেয় শাসনকে বুঝায়। প্রকৃতপক্ষে, এলিটবাদের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হল, সব সমাজেই দু'টি প্রধান শ্রেণির অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। 

এক শ্রেণি মুষ্টিমেয় ব্যক্তি (দক্ষ ও নেতৃত্বের গুণাবলিসম্পন্ন) যারা শাসক আর অপর শ্রেণি সংখ্যাগরিষ্ঠ (সাধারণ শ্রেণি) যারা শাসিত হয়, তাদের সমন্বয়ে গঠিত; এটি হচ্ছে এলিটবাদের মূলকথা। 

বস্তুত এলিটবাদের উৎপত্তি খুঁজে পাওয়া যায় কতিপয় বিশিষ্ট ইউরোপীয় চিন্তাবিদদের সমাজ চিন্তায়। বিশেষ করে প্যারেটো, মস্‌কা, মিশেল, সি. রাইট মিলস প্রমুখ উল্লেখযোগ্য ।

এলিট তত্ত্বের গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা : রাজনৈতিক অধ্যয়নের ক্ষেত্রে গতানুগতিক পদ্ধতির সাথে এলিট তত্ত্ব সুদীর্ঘকাল যাবৎ বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যবস্থা বিশ্লেষণে এলিট তত্ত্ব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। 

বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ক্ষমতার দাপট এর প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। আর এলিট তত্ত্বের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে রাষ্ট্রের বিভিন্ন শ্রেণির ক্ষমতার বিশ্লেষণ । 

নিম্নে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এলিট তত্ত্বের গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা বিশ্লেষণ করা হল :

ক্ষমতার বিশ্লেষণে এলিট তত্ত্ব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বলা হয়, "Power is the central concept of politics." 

সেজন্য ক্ষমতার বিভিন্ন উৎস, ক্ষমতার বর্তমান ও অতীত অবস্থা এবং এর ব্যবহার বা প্রয়োগবিধি প্রভৃতি এলিট তত্ত্বের (Elite theory) মাধ্যমে বিশ্লেষণ করা হয়। এর ফলে ক্ষমতার স্বরূপ বুঝার ক্ষেত্রে আমাদের জন্য অনেক সহজ হয়।

প্রত্যেক সমাজে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী সংগঠন বা Decision making body থাকে। সমাজে এ Elite শ্রেণি বা উচ্চতর শ্রেণি অধিক ক্ষমতা ব্যবহার করে থাকে। ফলে সমাজে যারা মৌলিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে তাদের সম্পর্কে অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণে এলিট তত্ত্ব সহায়তা করে।

অভিজাত শ্রেণি সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা পেতে Elite theory বা এলিট তত্ত্ব বিশেষ ভূমিকা পালন করে। Pareto বলেছেন, "History is the graveyard of Aristocracy." (ইতিহাস হল অভিজাততন্ত্রের সমাধিক্ষেত্র) এলিট তত্ত্ব অভিজাত শ্রেণি সম্পর্কে সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ করতে সহায়তা করে থাকে। 

ক্ষমতা প্রয়োগকারী ব্যক্তিবর্গ অথবা সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী নেতৃবর্গের মূল লক্ষ্য ও চিন্তাচেতনার বিশ্লেষণ থেকে সিদ্ধান্তের প্রকৃতি বা স্বরূপ সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। 

এলিট তত্ত্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী ব্যক্তিবর্গ বা নীতি প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষের আচরণ ও মানসকিতা বিশ্লেষণ করে। ফলে এ তত্ত্ব রাজনীতির একটি মৌলিক উপাদান অধ্যয়নের পথ প্রশস্ত করেছে।

বর্তমান সমাজকাঠামো বিশ্লেষণের ক্ষেত্রেও এলিট তত্ত্বের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এলিট তত্ত্ব কেবল এলিট বা উচ্চশ্রেণীর আচরণ ও মানসিকতাই অধ্যয়ন করে না সেই সাথে বিভিন্ন সমাজকাঠামোও বিশ্লেষণ করে। 

এ তত্ত্বের সাংগঠনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতি সমাজের কাঠামোর ভিত্তিতে এলিটকে ব্যাখ্যা করে। এলিট ভাত্ত্বিকেরা বুঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে, সমাজকাঠামোর প্রকৃতিই এলিট শাসনের জন্ম দেয়।

এলিট তত্ত্বের অপর গুরুত্বপূর্ণ ইতিবাচক দিক হল সম্পাদন সাধ্যতা। যে কোন অধ্যয়ন বা গবেষণার ক্ষেত্রে সম্পাদন সাধ্যতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে প্রতিপন্ন হয়। এলিট শ্রেণির সংখ্যা সমাজে কম থাকায় তাদের বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে অনেক সহজসাধ্য হয়।

সমাজ সর্বদা পরিবর্তনশীল। এলিট তত্ত্বের বিভিন্ন উপাদানসমূহ পরিবর্তনমুখী। প্রত্যেক তাত্ত্বিকেরা এলিটের আবর্তনের কথা বলেছেন। 

মূলত এর মাধ্যমে সমাজের পরিবর্তনশীলতার ছাপ স্পষ্ট হয়। এলিট কখনও স্থির নয় সেই সাথে সমাজের গতিশীলতা ও পরিবর্তনশীলতা একই নিয়মে চলে। এক্ষেত্রে এলিট তত্ত্বের ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই।

রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে এলিট তত্ত্ব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এলিট ও অ-এলিটদের মধ্যে যে দ্বন্দ্বসংঘাত হয় তার পূল কারণ হল ক্ষমতার নেতৃত্ব প্রয়োগ করা। 

এ দ্বন্দ্ব সংঘাতের ভিত্তিতে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় কোন ধরনের পরিবর্তন আসে তা এলিট তত্ত্ব বিশ্লেষণের মাধ্যমে জানা যায়। এভাবে রাজনীতি ও ক্ষমতা প্রয়োগকারী শক্তির মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় থাকে।

এলিট তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা : রাজনৈতিক ব্যবস্থা বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে এলিট তত্ত্ব গুরুত্বপূর্ণ ইতিবাচক ভূমিকা পালন করলেও এর কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বিভিন্ন তাত্ত্বিকগণ এলিট তত্ত্বের বিভিন্ন সমালোচনা করেছেন। 

নিম্নে এলিট তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা বা নেতিবাচক দিকসমূহ তুলে ধরা হল :

এলিট তত্ত্বের নেতিবাচক দিকসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল এ তত্ত্বের সংকীর্ণতা। আধুনিক রাজনৈতিক ২বস্থায় বা রাজনৈতিক আধুনিকীকরণের ক্ষেত্রে এ তত্ত্ব তেমন ফলদায়ক নয়।

এ তত্ত্বে উন্নয়ন বা অগ্রগতির ক্ষেত্রে নেতৃবৃন্দের অভিমত বিশ্লেষিত হয়। কিন্তু সমাজের অন্যান্য ব্যক্তিরা কিভাবে এটিকে গ্রহণ করবে সে সম্পর্কে কোন সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায় না। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি ও জনগণের যে ভূমিকা রয়েছে সে সম্পর্কে এলিট তত্ত্ব উদাসীন

এলিট (Elite) তত্ত্বের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, 'এলিট' কে। কিন্তু তাত্ত্বিকেরা এলিটের কোন সঠিক ব্যাখ্যা দিয়ে যেতে পারে নি।

এলিট তাত্ত্বিকেরা Governing elite, Rulling elite, Oligarchy, Power elite ইত্যাদি নামে Elite (এলিট) কে অভিহিত করেছেন। 

ফলশ্রুতিতে এ তত্ত্বের মূল ভূমিকা থেকে অনেকটা অস্পষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। যা রাজনৈতিক ব্যবস্থা বিশ্লেষণের জন্য কখনই গ্রহণযোগ্য নয়।

এলিট তত্ত্বে একটি ধারণাকে মৌলিক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু সমাজের বাস্তবতার ক্ষেত্রে অনেক সময় তা নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। 

মর্যাদা থাকলে এমনকি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষে থেকে অনেক সময় এলিট হওয়া কষ্টকর। এলিট তত্ত্ব মূলত রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গির প্রেক্ষিতে সৃষ্ট। 

এখানে আবর্তনের যে কথা বলা হয়েছে তা সমাজের উচ্চতর ও নিম্নতর তথা শাসক ও অশাসক শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে এ তত্ত্বে কোন গুরুত্ব দেয়া হয় নি।

এলিট তত্ত্বে গণতন্ত্র (Democracy) কে অবাস্তব হিসেবে প্রতিপন করা হয়েছে। তার মূল কারণ এ তত্ত্ব সমাজের মুষ্টিমেয় ব্যক্তির শাসনের যৌক্তিকতাকে প্রমাণ করার চেষ্টা করে। 

কিন্তু আধুনিক শাসনব্যবস্থায় গণতন্ত্রকে সর্বোত্তম শাসনব্যবস্থা হিসেবে স্বীকার করা হলেও এলিট তত্ত্বে গণতন্ত্রকে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়েছে। 

এলিট তত্ত্ব সমাজের সহযোগিতা বা একে অপরের মধ্যে Co-relation বা Co-operative মনোভাব পরিত্যাগ করে একে অপরের মধ্যে দ্বন্দ্ব বা সংঘাতের বিষয়টিকে বেশি High light করেছে। 

কিন্তু সমাজে দ্বন্দ্ব বা সংঘাতের পাশাপাশি সমাজ পরিবর্তন ও উন্নয়নের জন্য সহযোগিতাও একান্তভাবে প্রয়োজন । 

উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনা ও সমালোচনা থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, Elite theory (এলিট তত্ত্ব) সমাজ পরিবর্তনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। 

যদিও এলিট তত্ত্ব সমাজের একটি শ্রেণিকে অধিক মাত্রায় গুরুত্বের সাথে বিশ্লেষণ করেছে তবুও আধুনিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা বিশ্লেষণে এলিট তত্ত্বের ক্ষমতা বা 'Power elite' এর ধারণাকে কোনভাবেই অস্বীকার করা যায় না। 

এলিট তত্ত্ব Aristocrats বা অভিজাতদের নিয়ে আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখলেও বর্তমান উন্নয়নশীল ও উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক দেশেও ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব বিশ্লেষণে এলিট তত্ত্ব যথেষ্ট কার্যকর। 

এক্ষেত্রে Harold D. Lasswell এর উক্তিটি প্রণিধানযোগ্য, "The study of politics is the study of influence and the influential." 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ