রাজনৈতিক সংস্কৃতির ভিত্তিসমূহ আলোচনা কর

রাজনৈতিক সংস্কৃতির ভিত্তিসমূহ আলোচনা কর
রাজনৈতিক সংস্কৃতির ভিত্তিসমূহ আলোচনা কর

রাজনৈতিক সংস্কৃতির ভিত্তিসমূহ আলোচনা কর

উত্তর : ভূমিকা : বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিভিন্ন প্রকৃতির। যে কোন রাষ্ট্রের রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠার পিছনে বিভিন্ন উপাদান কাজ করে। 

এটি কোন একক উপাদানের উপর নির্ভরশীল নয়। অধ্যাপক Alan R. Ball তাঁর 'Modern Politics and Government' শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন, "A political culture, whether diverse or homogeneous is a product of many inter related factors." 

মূলত রাজনৈতিক সংস্কৃতির ভিত্তিগত উপাদানগুলো কেবল সংখ্যায় বহু তা নয়, বরং এ উপাদানগুলো পরস্পরের সাথে সম্পর্কযুক্ত। 

রাজনৈতিক সংস্কৃতির এসব ভিত্তিগত উপাদানগুলোকে রাজনৈতিক সংস্কৃতির নির্ধারক হিসেবে গণ্য করা হয় ।

রাজনৈতিক সংস্কৃতি : সাধারণ ভাষায় রাজনৈতিক সংস্কৃতি (Political culture) বলতে একটি রাজনৈতিক দলের শৃঙ্খলার ধরন, নেতা ও কর্মীদের আচার আচরণ ও চরিত্র, প্রতিপক্ষের প্রতি আচরণ, রাজনৈতিক নেতাদের সাথে কর্মীদের সম্পর্ক ও আচরণের ধরন, জনগণের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি, নেতাকর্মীদের শিক্ষাগত ও সাংস্কৃতিক মান প্রভৃতি গুণের সমষ্টিকে রাজনৈতিক সংস্কৃতি হিসেবে গণ্য করা হয়। প্রত্যেক দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটা নিজস্ব স্বকীয়তা পরিলক্ষিত হয়।

প্রামাণ্য সংজ্ঞা : রাজনৈতিক সংস্কৃতি সম্পর্কে বিভিন্ন মনীষী বা রাজনৈতিক বিজ্ঞানী বিভিন্ন ধারণা বা মতামত পোষণ করেছেন, যা পরবর্তীতে রাজনৈতিক সংস্কৃতির নির্ভরযোগ্য সংজ্ঞা হিসেবে গণ্য হয়েছে। 

নিম্নে কতিপয় সংজ্ঞা উল্লেখ করা হল : অধ্যাপক অমল কুমার মুখোপাধ্যায় তাঁর 'Political Sociology' শীর্ষক গ্রন্থে রাজনৈতিক সংস্কৃতি সম্পর্কে বলেন, "Political culture is composed of attitudes and orientation which people in a given society develop toward objects with in their political system."

অধ্যাপক অ্যালান বল (Alan R. Ball) তাঁর 'Modern Politics and Government' শীর্ষক গ্রন্থে বলেন, "A political culture is composed of the attitudes, beliefs, emotions and values of society that relate to the political system and political issues."

জি. এ. অ্যালমন্ড ও জি. বি. পাওয়েল (G. A Almond and G. B. Powel) তাঁদের 'Comparative Politics' শীর্ষক গ্রন্থে Political culture সম্পর্কে বলেন, "Political culture is the pattern of individual attitudes and orientations towards politics among the members of a political system."

অ্যালমন্ড ও ভার্বা (Almond and Verba) তাঁদের 'Civic Culture' শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেন, "The political culture of a nation is the particular distribution of pattern of orientations toward political objects among the members of a nation."

এল. ডব্লিউ পাই (L. W. Pye) তাঁর 'Aspects of Political Development' গ্রন্থে বলেছেন, "Political culture is thus the manifestation in aggregate form of the psychological and subjective dimensions of politics."

উপরিউক্ত সংজ্ঞাগুলোর আলোকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, রাজনৈতিক সংস্কৃতি হচ্ছে কোন দেশ বা জাতির রাজনৈতিক বিষয়ে মূল্যবোধ বা মাত্রাবোধের প্রতীক ।

রাজনৈতিক সংস্কৃতির ভিত্তিসমূহ : বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠার পিছনে কতকগুলো কারণ কাজ করে। 

এসব ভিত্তিগত বা নির্ধারক উপাদান হিসেবে যে সমস্ত প্রত্যয়গুলো কাজ করে তা হল- ঐতিহাসিক বিকাশ, ঔপনিবেশিক শাসন, ভৌগোলিক অবস্থা বা অবস্থান, জাতিগত বিভিন্নতা, ধর্ম, আর্থসামাজিক কাঠামো, রাজনৈতিক মতাদর্শগত প্রভাব ইত্যাদি । 

নিম্নে এসব উপাদানগুলো বর্ণনা করা হল :

১. ঐতিহাসিক বিকাশের ধারা (Historical development): বিশ্বের যে কোন দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক সংস্কৃতির উপর দেশের ঐতিহাসিক বিকাশের ধারার গভীর প্রভাব কোনভাবেই অস্বীকার করা যায় না। 

এসব ঐতিহাসিক বিকাশের ধারা পর্যালোচনার প্রেক্ষিতে একটি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যবস্থার নিরবচ্ছিন্নতা প্রমাণিত হয় এবং এর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক সংস্কৃতির ভিত্তি সম্পর্কে অবগত হওয়া যায়। 

এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক জোহারী (J. C. Johari ) বলেন, "A study of history offers ample authentic evidence to prove the continuity or discounting of a political system behind which the foundation of a political culture well be found out."

উদাহরণ : বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক বল বিষয়টি ব্যাখ্যা করার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন মহাদেশের বিভিন্ন দেশের ঐতিহাসিক বিকাশের ধারা পর্যালোচনা করেছেন। 

এক্ষেত্রে তিনি গ্রেট ব্রিটেনের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি এর ব্যাখ্যায় বলেন, ইংল্যান্ডের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় এক নিরবচ্ছিন্ন ধারার অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। 

মূলত ব্রিটেনের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ঐতিহ্যগত ধারার সাথে আধুনিকতার এক অভিনব সমন্বয় সাধিত হয়েছে। 

অন্যদিকে, আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কতকগুলো সামাজিক পরিবর্তন সাধিত হয়। তবে মূলত এ স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটেনের সাথে রাজনৈতিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা। 

তাছাড়া এর মাধ্যমে উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কতকগুলো পদ্ধতির ব্যাপারে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। 

এক্ষেত্রে অধ্যাপক বল বলেন, The revolution did establish a stable political system based on new egalitasian and competitive values were not fundamentally changed by the later industrialisation and mass immigration."

২. ঔপনিবেশিক শাসন (Colonial domination) : রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির কাঠামো ও প্রকৃতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাব প্রতিক্রিয়াকে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। 

প্রাচীন যুগে উপনিবেশগুলোর রাজনৈতিক ব্যবস্থা পর্যালোচনা করলে এ বিষয়ে বিস্তারিত অবগত হওয়া যায়। 

সে সময়ের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যে সমস্ত দেশে সুদীর্ঘকাল ধরে ঔপনিবেশিক শাসনাধীনে কাটিয়েছে তাদের প্রত্যেকের উপর প্রাক্তন ঔপনিবেশিক শাসকের রাজনৈতিক সংস্কৃতির স্থায়ী প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।

উদাহরণ :- এখানে ভারতের রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও সংস্কৃতির দৃষ্টান্ত বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ভারতের বর্তমান সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা, আমলাতান্ত্রিক কাঠামো, বিচার বিভাগীয় সংগঠন ও পদ্ধতি, ভোটাধিকারের নীতি প্রভৃতি ব্রিটিশ শাসকের কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া। 

এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক জোহারী (J. C. Johari) মন্তব্য করেন, ......The Indians learnt from their British masters the values of parliamentary democracy and efficiency of the constitutional means."

৩. ভৌগোলিক অবস্থা (Geographical position) : পৃথিবীর যে কোন রাষ্ট্রের ভৌগোলিক অবস্থান তার রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। 

এ সম্পর্কে অধ্যাপক Alan R. Ball বলেন, "Geography is another important factor is in fashioning a political culture." এ প্রসঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভৌগোলিক অবস্থান ও গ্রেট ব্রিটেনের ভৌগোলিক অবস্থানের কথা বলা যায়। 

বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিহত করার ক্ষেত্রে এ দু'টি দেশ স্বাধীনভাবে তাদের নিজেদের সত্তার প্রভাবে নিজস্ব রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে। 

অন্যদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রাকৃতিক সম্পদে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ। এ সমৃদ্ধি মার্কিন রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে স্থায়িত্ব দান করেছে। 

আবার গ্রেট ব্রিটেনের ভৌগোলিক অবস্থান দেশটির জনগণকে বৈদেশিক আক্রমণ থেকে নিরাপদ রেখেছে। 

অন্যদিকে, ভৌগোলিক অবস্থান মোট ব্রিটেনকে ব্যাপক হারে বিদেশীর অভিবাসনের আশংকা থেকে অব্যাহতি দিয়েছে।

৪. জাতিগত বিভিন্নতা (Ethic difference) : দেশবাসীর মধ্যে জাতিগত বিচারে ব্যাপক বিভিন্নতা পরিলক্ষিত হলে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির উপর বিশেষ প্রভাব পড়ে। 

জাতিগত প্রবণতা প্রবল হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের আনুগত্য জাতীয় সরকারের পরিবর্তে নিজ জাতির প্রতি প্রদর্শিত হয়। 

আবার এ জাতিগত ভিত্তিতে পররাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যের সৃষ্টি হলে দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় অস্থিরতা দেখা দিতে পারে।

উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায়, কোন দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি (Political culture) সে দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার মূল্যবোধের প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হয়। 

কোন দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র থাকে। ফলে কোন দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা কতটা শক্তিশালী ও দুর্বল হবে তা নির্ভর করে সে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক সংস্কৃতির উপর। 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ