সনাতন সমাজের মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা কর

সনাতন সমাজের মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা কর
সনাতন সমাজের মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা কর

সনাতন সমাজের মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা কর

  • অথবা, গতানুগতিক সমাজের মূল বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও ।

উত্তর : ভূমিকা : আদিম সমাজের মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা থেকে সনাতন সমাজের একটা চিত্র পাওয়া যায়। পরবর্তীতে আধুনিক সমাজের শুরু বা গোড়াপত্তন হয়, তখন থেকে মানুষের সুচিন্তিত মতামত বা জ্ঞানগর্ভ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। 

তবে এটা বলা যায়, আধুনিক সমাজ হল সনাতন সমাজের ভিত্তি। পাশাপাশি এটাও বলা যায় যে, সনাতন সমাজের পথ ধরেই মূলত আধুনিক সমাজ আজ উন্নতির চরম সীমায় উপনীত হতে সক্ষম হয়েছে।

সনাতন সমাজের মৌলিক বৈশিষ্ট্য : প্রতিটি সমাজের কতকগুলো নিজস্ব স্বকীয়তা বা বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয় । সনাতন সমাজেরও তেমন কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। 

নিম্নে সেগুলো আলোচনা করা হল :

১. কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থা : সমাজবিজ্ঞানী F. X. Shutton এর মতে, “সনাতন সমাজ মূলত কৃষিভিত্তিক সমাজ।” তখনকার মানুষের প্রধান জীবিকা ছিল মূলত কৃষি। 

"Ancient society is based on agriculture and their principal source of income derived from agriculture." তখনকার মানুষের প্রধান জীবিকাই ছিল কৃষি। তখন মানুষ আধুনিক প্রযুক্তির সাথেও বিজ্ঞানের তেমন পরিচিত ছিল না বললেই চলে।

২. ধর্মীয় গোঁড়ামি : ধর্মীয় গোঁড়ামি ছিল সনাতন সমাজের অন্যতম মৌলিক বৈশিষ্ট্য। তখনকার সময়ে যাবতীয় কার্যকলাপ ধর্মকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হতো। সমাজবিজ্ঞানী David Apter সনাতন সমাজকে “ধর্মভিত্তিক সমাজ” বলে আখ্যায়িত করেছেন ।

৩. অন্ধবিশ্বাস : সনাতন সমাজের অন্যতম মৌলিক বৈশিষ্ট্য ছিল অন্ধবিশ্বাস। সে সমাজের মানুষ অধিকাংশই অন্ধবিশ্বাসে বিশ্বাসী ছিল। 

সে সময়কে মহান সৃষ্টিকর্তা তথা আল্লাহ বা ঈশ্বরকে প্রভু জ্ঞান করা হতো। ঈশ্বর বা আল্লাহই ছিলেন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। 

তারা ভাবত সমগ্র রুজির মালিক আল্লাহ। কিন্তু এর জন্য যে পরিশ্রম করত এটা তারা কখনই স্বীকার করত না।

৪. পারিবারিক বন্ধন : সনাতন সমাজ ছিল মূলত পারিবারিক বন্ধনে আবদ্ধ। সে সময়ে পারিবারিক বন্ধনের মাধ্যমেই গড়ে উঠত গোত্র । গোত্র প্রধানরা সাধারণত তাদের গোত্রের বাইরে কাজ করতে নারাজ ছিল ।

৫. লোকাচার ও রীতি : সনাতন বা গতানুগতিক সমাজ মুখ্যত প্রথা, লোকাচার ও রীতি দ্বারা পরিচালিত এবং নিয়ন্ত্রিত হতো। তখন রাজনৈতিক শাসন অভিমাত্রায় কর্তৃত্বপরায়ণ (Authoritarian) ছিল। 

তখনকার সমাজব্যবস্থা ছিল পশ্চাৎপদ এবং তখন তেমন নগরায়ন হয় নি। Macridis এবং Brown বলেন, "Family values, personal Joyalty, authority reverence, pervade the whole social structure.

৬. সীমিত প্রযুক্তি : গভানুগতিক সমাজ সীমিত প্রযুক্তির অধিকারী (Limited techonology), এ সমাজের নতুনত্ব (Innovation) সৃষ্টির ক্ষমতা খুবই কম। কারণ সৃজনশীল লোকের (Inventors) সংখ্যা খুবই কম।

৭. কুড়ে সমাজ : সনাতন সমাজ ছিল মূলত জরাজীর্ণ এবং কুড়ে সমাজ। এখানকার ধ্যানধারণা, রীতিনীতির দিকে তাকালে সহজেই অনুমেয় করা যায় যে এটা একটা সনাতন সমাজ। তখনকার সময়ে জনগণ ছিল মূলত কর্মবিমুখ কিছুটা আল্লাহর নীতিতে বিশ্বাসী ।

৮. সামাজিক পদমর্যাদা : তখনকার সময়ে সামাজিক পদমর্যাদা (Social status) নির্ধারিত হতো মূলত কৃষিজমির মালিকানার ভিত্তিতে। 

নিয়ন্ত্রণাধিকার ক্ষুদ্র সংখ্যক অভিজাত ও সামন্তপ্রভুদের হাতে কেন্দ্রীভূত ছিল। ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা খুবই বেশি ছিল।

অন্যান্য বৈশিষ্ট্য : সনাতন সমাজের কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্যের পাশাপাশি কিছু আনুষঙ্গিক বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয় তা নিম্নরূপ :

৯. বাল্যবিবাহ : সনাতন সমাজের একটা অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল যে তখনকার সমাজে বাল্যবিবাহ একটা প্রচলিত রীতিনীতি হিসেবে গণ্য করা হতো। 

তারা ছেলেমেয়েদের বাল্যকালে বিবাহ প্রদান করে গুরুদায়িত্ব পালন করেছে বলে মনে করত। বাল্যবিবাহের সে ধারবাহিকতা বর্তমান সমাজব্যবস্থায় তেমন প্রচলিত নেই বললেই চলে।

১০. বহুবিবাহ : সনাতন সমাজের লোকেরা বরাবরই বহুবিবাহে আবদ্ধ হতো, যা আধুনিক সমাজব্যবস্থায় কখনই কাম্য নয়। এ বহুবিবাহের কারণে সংসারে কলহ, কপড়া, বিবাদ এবং অভাব অনটন সর্বদা লেগে থাকত।

১১. গতিহীন সমাজ : সনাতন সমাজের জনগণ সবসময়ই তাদের কর্মের ফল ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিত। তারা বিশ্বাস করতে পারত না যে কর্মেই মানুষের যুক্তি। সেজন্য সনাতন সমাজ ছিল মূলত গতিহীন সমাজ।

১২. শিক্ষার অপ্রতুলতা : সনাতন সমাজের শিক্ষাব্যবস্থা ছিল খুবই ভঙ্গুর এবং সামগ্রিকভাবে শিক্ষাব্যবস্থা তথা শিক্ষার আলো সমাজে তেমন ছিল না বললেই চলে ।

১৩. নারী শিক্ষার বাধা : সনাতন সমাজব্যবস্থা নারী শিক্ষার ঘোর বিরোধী ছিল। তারা শিক্ষাকে পাপ বলে মনে করত। কিন্তু সমাজের নারীরা শিক্ষিত না হলে সঠিক সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারে না।

১৪. যোগাযোগ ব্যবস্থা : সনাতন সমাজের যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল খুবই নিম্নমানের। তারা গরু বা ঘোড়ারগাড়িকে প্রধান বাহন হিসেবে গণ্য করত। ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল যথেষ্ট ভঙ্গুর ও গতিহীন।

১৫. রাজনৈতিক অসচেতনতা : "Political unconsciousness is the one of the basic criteria of the ancient society." সনাতন সমাজব্যবস্থা মূলত ছিল অরাজনৈতিক ও অন্ধকারাচ্ছন্ন। রাজনৈতিকভাবে তখনকার জনগণ তেমন সচেতন ছিল না।

১৬. অবৈজ্ঞানিক সমাজব্যবস্থা : M. I. T. Study Group বলেন, "Basically, these societies lacked the adaptability to adjust their behaviour to new circumstances." 

অর্থাৎ, নতুন অবস্থার সাথে নিজেদের আচরণকে খাপখাইয়ে নিতে পারে না। জনগণের বৈজ্ঞানিক মনোবৃত্তি ও প্রযুক্তিবিদগণের অভাবই এজন্য দায়ী।

উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার পর আমরা বলতে পারি যে, সনাতন সমাজ ছিল মূলত অন্ধকারাচ্ছন্ন। সে সময় ছিল ধর্মীয় গোঁড়ামি আর আল্লাহর আইনে বিশ্বাসী এবং কৃষিই ছিল মানুষের জীবিকার প্রধান হাতিয়ার। 

এ সম্পর্কে গুস্তাব-লি-বোন (Gustave Le Bon) এর মতে, To respect tradition is a condition of existence for a people to know how disengage from if a condition for progress." 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ