সি রাইট মিলসের এলিটবাদ তত্ত্বটি পর্যালোচনা কর

সি রাইট মিলসের এলিটবাদ তত্ত্বটি পর্যালোচনা কর
সি রাইট মিলসের এলিটবাদ তত্ত্বটি পর্যালোচনা কর

সি রাইট মিলসের এলিটবাদ তত্ত্বটি পর্যালোচনা কর

  • অথবা, এলিটবাদ সম্পর্কে সি. রাইট মিলসের বক্তব্য পর্যালোচনা কর।

উত্তরঃ ভূমিকা : সমাজ ও রাষ্ট্রীয়ব্যবস্থা বিশ্লেষণে গতানুগতিক পদ্ধতির বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে এলিট তত্ত্বের আত্মপ্রকাশ ঘটে। 

গতানুগতিক ও রীতিসিদ্ধ পদ্ধতিতে যেখানে সরকারের প্রাতিষ্ঠানিক উপাদানগুলোর উপর গুরুত্বারোপ করা হয় সেখানে স্বল্পসংখ্যক ব্যক্তিবর্গ যারা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সাথে যুক্ত থাকেন তাদের আচার আচরণ ও ক্রিয়াকলাপের উপর অত্যধিক গুরুত্বারোপ করে। 

বস্তুত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিতের পর থেকেই এলিটবাদ স্বীয় স্বকীয়তা ও বৈশিষ্ট্যের বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হয়ে উঠে। এ তত্ত্ব মূলত রাজনীতির সনাতন পদ্ধতির বিকল্পব্যবস্থা হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করে। 

যদিও ইতালীয় সমাজবিজ্ঞানী ভিলফ্রেডো প্যারেটো এলিট তত্ত্বের অন্যতম পথিকৃত তথাপিও এ তত্ত্বের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশে সি. রাইট মিলের অবদানকে অস্বীকার করা যায় না।

এলিট তত্ত্ব (Elite theory) : আভিধানিক অর্থে এলিটবাদ বলতে উৎকৃষ্ট শ্রেণির মুষ্টিমেয় শাসনকে বুঝায় । প্রকৃতপক্ষে, এলিটবাদের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হল, সব সমাজেই দু'টি প্রধান শ্রেণির অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। 

এক শ্রেণি মুষ্টিমেয় ব্যক্তি (দক্ষ ও নেতৃত্বের গুণাবলিসম্পন্ন) যারা শাসক আর অপর শ্রেণি সংখ্যাগরিষ্ঠ (সাধারণ শ্রেণি) যারা শাসিত হয়, তাদের সমন্বয়ে গঠিত; এটি হচ্ছে এলিটবাদের মূলকথা। 

বস্তুত এলিটবাদের উৎপত্তি খুঁজে পাওয়া যায় কতিপয় বিশিষ্ট ইউরোপীয় চিন্তাবিদদের সমাজ চিন্তায়। বিশেষ করে প্যারেটো, মস্‌কা, মিশেল, সি. রাইট মিলস প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।

সি. রাইট মিলস বর্ণিত এলিটবাদ : এলিটবাদ বা এলিট তত্ত্বের আলোচনায় যেসব সমাজবিজ্ঞানী গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন তাদের মধ্যে মার্কিন রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানী সি. রাইট মিলস অন্যতম। 

মার্কিন সমাজব্যবস্থা ও ক্ষমতা কাঠামোর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি তাঁর এলিট তত্ত্ব সম্পর্কিত আলোচনাকে উপস্থাপিত করেছেন। 

মিলস মূলত প্রাতিষ্ঠানিক পর্যালোচনার মাধ্যমে এলিট শাসন ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর অভিমত অনুসারে সমাজের বিশেষ কিছু প্রতিষ্ঠানের কর্তৃত্বপূর্ণ উচ্চপদ অধিকারের মাধ্যমে সর্বোচ্চ অবস্থানের মূল চাবিকাঠি করায়ত্ত করা যায়। 

এ ধরনের প্রতিষ্ঠানসমূহের নিয়ন্ত্রণমূলক অবস্থানে ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে এলিট শ্রেণি গঠিত হয়। অন্যান্য এলিটবাদীরা উৎকর্ষে উন্নততর গুণগত যোগ্যতার পরিপ্রেক্ষিতে এলিট শ্রেণির প্রাধান্যের বিষয়টিকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন। এলিট তত্ত্বের ব্যাখ্যায় মিলস মনস্তাত্ত্বিক পথকে পরিহার করেছেন।

সি. রাইট মিলসের (C. Right Mills) মতানুসারে প্রতিষ্ঠানিক কাঠামোই এলিট শ্রেণির আর্বিভাবে সাহায্য করে। প্রতিষ্ঠানিক ক্রমোচ্চ স্তরবিন্যাস সমাজব্যবস্থার সর্বোচ্চ স্তরে উপবিষ্ট ব্যক্তিবর্গই ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে সমর্থ হয়। 

সমাজে ক্ষমতা সংযুক্ত থাকে প্রতিষ্ঠানের সাথে এবং প্রতিষ্ঠানের কর্তৃত্বমূলক সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিতরাই ক্ষমতা এলিট গঠন করে।

যিলস (Mills) তাঁর The Power Elites' শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তিনি মার্কিন ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিত মূলত তিন ধরনের প্রধান প্রাতিষ্ঠানিক এলিটের কথা বলেছেন। 

এ তিন ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক এলিট হচ্ছে :

১. কর্পোরেশন নেতৃবর্গ (Corporation leaders),

২. রাজনৈতিক নেতৃবর্গ (Political leaders) এবং

৩. সামরিক বাহিনীর প্রধানগণ (Military Chiefs) ।

মার্কিন সমাজব্যবস্থায় এ তিন শ্রেণির মানুষের প্রভুত্ব বা প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হতে দেখা যায়। এ তিন ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক এলিটরা ক্ষমতাবান এলিট হিসেবে প্রতিপন্ন হন। অর্থাৎ উপরিউক্ত তিন ধরনের প্রতিষ্ঠানের এলিটদের নিয়ে গঠিত হয় ক্ষমতা এলিট।

মিলসের অভিমত অনুসারে তিন শ্রেণির প্রাতিষ্ঠানিক এলিটদের সংযোগের ভিত্তিতে ক্ষমতা এলিট গঠিত হয় এবং এ তিন ধরনের এলিটদের সংযুক্ত হওয়ার পিছনে কতকগুলো কারণ বর্তমান। এ কারণগুলো হল :

i. এ তিন শ্রেণির প্রাতিষ্ঠানিক এলিটদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সম্পর্ক

ii. সামাজিক পটভূমির সাদৃশ্য।

iii. প্রায়শই পারস্পরিক ভূমিকা বিনিময় ও অধিক্রমন প্রভৃতি।

মিলসের মতানুসারে মার্কিন সমাজ হল আমজনতার সমাজ। মার্কিন সমাজের গুরুত্বপূর্ণ যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ক্ষমতা এলিটরাই এবং এ ক্ষমতা এলিটরাই চাতুর্য বিনোদন ও তোষামোদের মাধ্যমে আমজনতাকে শান্ত করে রাখে। 

মার্কিন সমাজে আমজনতা হল অসংগঠিত। এ কারণে মার্কিন জনসাধারণের কাছে ক্ষমতা এলিটদের কোন দায়বদ্ধতা দেখা যায় না। স্বাভাবতই মার্কিন সমাজে ক্ষমতাবান এলিটদের মধ্যে দুর্নীতি প্রশ্রয় পায় ।

সমালোচনা : এ পৃথিবীতে এমন কিছু নেই যা সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। আর এরই ধারাবাহিকতায় সি. রাইট মিলস বর্ণিত এলিটবাদও এর ব্যতিক্রম নয়। 

নিম্নে সংক্ষেপে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হল :

i. রবার্ট ডালের মতে : রবার্ট ডাল মিলসের এলিট তত্ত্বের সমালোচনা করে বলেন, “সিদ্ধান্ত গ্রহণের পটভূমিতে যেসব বাস্তব ঘটনা বর্তমান তার পরীক্ষা নিরীক্ষা প্রয়োজন, অন্যথায় নিয়ন্ত্রণমূলক প্রকৃত ক্ষমতার প্রয়োগ অনুধাবন করা যাবে না। 

এ বিষয়ে মিলস সতর্ক ছিল না। নিয়ন্ত্রণমূলক ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ এবং প্রকৃতপক্ষে নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা সমর্থক নয়। এ বিষয়টি মিলসের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে।

ii. কাল্পনিক : অনেক তাত্ত্বিক মিলসের এলিট তত্ত্বটি সমালোচনা করতে গিয়ে বলেন, এ তত্ত্বটি কাল্পনিক ও অবাস্তব। বাস্তবতার সাথে এর কোন মিল নেই।

iii. অবস্থানগত ও ইঙ্গিতসূচক : মিলসের এলিট তত্ত্বের আলোচনা, সিদ্ধান্তসমূহ অবস্থাগত ও ইঙ্গিতসূচক পর্যালোচনার উপর নির্ভরশীল।

উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, এলিট হচ্ছে এমন এক জনসমষ্টি যাদের নিজস্ব কর্মক্ষেত্রে সর্বাধিক দক্ষতা রয়েছে। 

যদিও সি. রাইট মিলসের এলিট তত্ত্বের যথেষ্ট সমালোচনা রয়েছে, তথাপিও তাঁর এ তত্ত্বের প্রাসঙ্গিকতা ও প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করা যায় না। 

বস্তুত মার্কিন সমাজব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মিলসের এলিটবাদী আলোচনায় গুরুত্ব ও উপযোগিতা বিরোধ বিতর্কের ঊর্ধ্বে। 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ