তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বর্ণনা কর

তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বর্ণনা কর
তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বর্ণনা কর

তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বর্ণনা কর

  • অথবা, তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা কী? এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আলোচনা কর ।
  • অথবা, তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য লেখ।

উত্তর : ভূমিকা : দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সাফল্য ও ব্যর্থতার আলোকে বাংলাদেশের তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৮৫-৯০) প্রণীত হয়। 

এ পরিকল্পনায় জনসংখ্যার নিয়ন্ত্রণ, উৎপাদনমুখী কর্মসংস্থান, প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা বৃদ্ধি, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, মৌলিক প্রয়োজনীয় দ্রব্যের যোগান নিশ্চিতকরণ, অবকাঠামো ও উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন সংক্রান্ত নীতিমালা অগ্রাধিকার পায়। 

তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী এ পরিকল্পনায় এরশাদ সরকারের নবগঠিত বিকেন্দ্রীকৃত শাসনব্যবস্থার ভিত্তি সুদৃঢ়করণে বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। 

এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে দেশের ৪৬০টি উপজেলার অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পে মোট ২,২৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয় ।

তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা : বাংলাদেশের তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ১৯৮৫ সালের ১ জুলাই থেকে শুরু হয়। পাঁচ বছর মেয়াদি এ পরিকল্পনা ১৯৯০ সালের ৩০ জুন শেষ হয়। 

এ পরিকল্পনায় মোট ব্যয়বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ৩৮,৬০০ কোটি টাকা । তুলনামূলকভাবে তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বেসরকারি খাতের তুলনায় সরকারি খাতে মোট ব্যয়বরাদ্দ বেশি ছিল। 

সরকারি খাতে মোট ব্যয়বরাদ্দ ছিল ২৫,০০০ কোটি টাকা যা মোট ব্যয়বরাদ্দের ৬৫ ভাগ এবং বেসরকারি খাতে মোট ব্যয়বরাদ্দ ছিল ১৩,৬০০ কোটি টাকা যা মোট ব্যয়বরাদ্দের শতকরা ৩৫ ভাগ। 

তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় অভ্যন্তরীণ উৎস হতে ১৭,৫৭২ কোটি টাকা যা মোট ব্যয়বরাদ্দের ৪৪.৬ ভাগ এবং বৈদেশিক উৎস হতে ২১,০২৮ কোটি টাকা যা মোট ব্যয়বরাদ্দের ৫৪.৪ ভাগ লক্ষ্যমাত্রা নিশ্চিত করা হয়। 

সর্বোপরি দেশীয় সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে স্বনির্ভরতা অর্জন করে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত করাই ছিল বাংলাদেশের তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার প্রধান লক্ষ্য। এ পরিকল্পনার প্রধান প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহ নিম্নে প্রদত্ত হলো :

তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য : বাংলাদেশের তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ৩৮,৬০০ কোটি টাকা মোট ব্যয়বরাদ্দ লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে অগ্রযাত্রা শুরু করে। 

বিশেষত দেশের ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্য হ্রাস, বেকারত্ব দূরীকরণ, অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ বেশকিছু লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়। যেমন—

১. জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ : বাংলাদেশের তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ। দেশে অধিকসংখ্যক মাতৃসদন, স্বাস্থ্য সুবিধা কেন্দ্র, জন্ম নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে পরিকল্পনা শেষে অর্থাৎ ১৯৯০ সাল নাগাদ জনসংখ্যা বৃদ্ধির শতকরা ২.৪ ভাগ থেকে শতকরা ১.৮ ভাগে নামিয়ে আনা ।

২. সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা : এ পরিকল্পনায় নিরক্ষরতা দূরীকরণ ও মানবসম্পদ উন্নয়নের লক্ষ্যে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়। 

তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী এ পরিকল্পনায় বাস্তবমুখী শিক্ষা সম্প্রসারণের জন্য শিক্ষা ও ধর্ম খাতে ১৩৭০ কোটি টাকা মোট ব্যয়বরাদ্দ করা হয়।

৩. খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন : তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী এ পরিকল্পনায় খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়। খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি উৎপাদন বৃদ্ধি ও বৈদেশিক নির্ভরতা হ্রাস করাই ছিল এ পরিকল্পনার গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য। 

এ পরিকল্পনার শেষ মেয়াদে অর্থাৎ ১৯৮৯-৯০ সালে খাদ্য উৎপাদন ২০৭ লাখ মেট্রিক টন লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়।

৪. জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন : বাংলাদেশের তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে মৌলিক প্রয়োজনীয় দ্রব্যসমূহের পর্যাপ্ত যোগান নিশ্চিত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়। 

খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য মৌলিক প্রয়োজনীয় দ্রব্যের পর্যাপ্ত যোগান নিশ্চিত করাই ছিল এ পরিকল্পনার অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।

৫. পল্লি উন্নয়ন : বাংলাদেশের তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় কৃষি, পানি সম্পদ ও পল্লি উন্নয়নের ওপর অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। 

পরিকল্পনার শেষার্ধে ১৯৮৯-৯০ সাল নাগাদ ১৬.৪৪ লাখ একর জমিতে পানি সেচ ও ৮২.৫৪ লাখ একর জমিতে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পানি নিষ্কাশনের সুবিধা প্রদান নীতি গ্রহণ করা হয়। এসব লক্ষ্যমাত্রা নিশ্চিতকল্পে এ খাতে সর্বমোট বরাদ্দ ছিল ১১,৪৬০ কোটি টাকা ।

৬. কৃষির আধুনিকীকরণ : বাংলাদেশের তৃতীয় পদ্মবার্ষিকী পরিকল্পনার গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো কৃষি খাতের আধুনিকীকরণ। দেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামো সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠাকল্পে কৃষিক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা।

৭. উপজেলা অবকাঠামোর উন্নয়ন : তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল এরশাদ সরকারের নবগঠিত বিকেন্দ্রীকৃত শাসনব্যবস্থার সফল বাস্তবায়নের লক্ষ্যে উপজেলা অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়ন। এ লক্ষ্যমাত্রা নিশ্চিতকল্পে এ খাতে ১০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়।

৮. সমাজকল্যাণ : বাংলাদেশের তৃতীয় পণবার্ষিকী পরিকল্পনার অন্যতম লক্ষ্য ছিল সমাজকল্যাণ, যব উন্নয়ন, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন, এ লক্ষ্যমাত্রা নিশ্চিতকল্পে এ খাতে ৩২২ কোটি টাকা মোট বরাদ্দ ব্যয় ধার্য করা হয় যা মোট ব্যয়ের ০.৮৩ ভাগ।

৯. সঞ্চয় বৃদ্ধি : তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় সরকারি এবং বেসরকারি উভয় খাতে সঞ্জয় বৃদ্ধি করা। পরিকল্পনা শেষে ১৯৮৯-৯০ সালে অভ্যন্তরীণ খাত ৯.৪ ভাগে উন্নীত করার কথা বলা হয়। এছাড়া জাতীয় সঞ্চয় শতকরা ৯.৩% হারে বৃদ্ধি করার লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয় ।

১০. আত্মনির্ভরতা বৃদ্ধি : বাংলাদেশের তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী এ পরিকল্পনার অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল উপজেলা ও জেলা উন্নয়ন ফান্ড গঠনের মাধ্যমে অত্মনির্ভরতা বৃদ্ধি করা। 

সরকারি ও বেসরকারি খাত মিলে এ খাতে মোট বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ১,২৫০ কোটি টাকা যা মোট বরাদ্দের ৩.২৪% ।

১১. সেবা খাতে : বাংলাদেশের তৃতীয় পদ্মবার্ষিকী পরিকল্পনায় ফিজিক্যাল প্ল্যানিং, গৃহনির্মাণ ও পানি সরবরাহ প্রভৃতি সেবা খাতের প্রতি বিশেষ গুৰুত্ব পায়। 

এ খাতে মোট বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ৪,২০০ কোটি টাকা যা মোট বরাদ্দের ১০.৮৮%। ১২. তৃতীয় পণবার্ষিকী পরিকল্পনায় বেকার সমস্যা দূরীকরণ ও অধিকসংখ্যক কর্মসংস্থান সৃষ্টির ওপর বিশেষ লক্ষ্য নির্ধারিত হয় । 

১৯৮৯-৯০ সাল নাগাদ অতিরিক্ত ৫১ লাখ কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করাই ছিল এ পরিকল্পনার অন্যতম লক্ষ্য । 

উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বাংলাদেশের তৃতীয় পদ্মবার্ষিকীয় পরিকল্পনা প্রাতিষ্ঠানিক অদক্ষতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্যা, বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতির চাপ, দেশীয় সম্পদের ঘাটতি, বৈদেশিক সাহায্য প্রাপ্তির অনিশ্চয়তা, রাজনৈতিক অস্থিরতা প্রভৃতি কারণে অধিকাংশ অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। 

যদিও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও কাঠামোগত স্বনির্ভরশীলতা অর্জনে এ পরিকল্পনা বেশ ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ