বিসর্জন' নাটকটি পঞ্চম অঙ্কের প্রথম দৃশ্যে শেষ হলে কী এমন লাভ বা ক্ষতি হত আলোচনা কর
বিসর্জন' নাটকটি পঞ্চম অঙ্কের প্রথম দৃশ্যে শেষ হলে কী এমন লাভ বা ক্ষতি হত আলোচনা কর
![]() |
উত্তর: সমগ্র রবীন্দ্র নাট্যসাহিত্যের মধ্যে 'বিসর্জন' নাটকটি আখ্যানবস্তুর সুনিপুণ বিন্যাস কৌশলে, ঘটনার দ্রুত প্রবাহে, নাটকীয় চমৎকারিত্বে, পাত্রপাত্রীর অন্তর্নিহিত ভাবধারায় ও বাইরের কর্মের সম্মিলিত দ্বন্দ্ব-সংঘাতময় বেগবান রূপের প্রকাশে, মঞ্চাভিনয়ের উপযোগিতায় একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। পঞ্চমাঙ্কের প্রথম দৃশ্যের পর নাটকটি শেষ হয়ে গেলে হয়ত ভাল হত। একথা বলার পক্ষে কী যুক্তি আছে তা ভেবে দেখা যেতে পারে।
মনে হয়, তাহলে রঘুপতির চরিত্রের সংগতি রক্ষা পেত এবং রঘুপতি আরও জীবন্ত হয়ে বেঁচে থাকতে পারত। জয়সিংহ যেখানে একটি নিষ্ঠুর বিধানের নিচে আত্মদান করল, যেখানে এক মুহূর্তে স্নেহের আপন কোণটিতে প্রচণ্ড বেদনার আঘাত লেগে রঘুপতির চৈতন্য ফিরে আসল, যেখানে একান্ত প্রিয় জয়সিংহকে হারিয়ে অপর্ণাও কিছুতেই নিজেকে অবিচল রাখতে পারল না সেখানেই যদি নাটকের পরিসমাপ্তি ঘটত, তাহলে অভিনয় হিসেবে 'বিসর্জন'-এর রসমাধুর্য আরও নিবিড় হতে পারত ।
শুধু ঘটনাবস্তুর বিকাশের দিক হতে দেখতে গেলেও আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় এরপর রঘুপতি অথবা অপর্ণা, গোবিন্দমাণিক্য, গুণবতী কার কী হল, ঘটনার স্রোত কোন পথে চলল— এসব জানবার ঔৎসুক্য পাঠক অথবা দর্শকের থাকে না। জয়সিংহের বিসর্জনের (আত্মাহুতির) সঙ্গে সঙ্গেই তার আকর্ষণ শিথিল হয়ে যায়। অপর্ণার চরিত্র যে একটা আইডিয়ার রূপক হয়ে পড়তে বাধ্য হয়েছে, তার জন্য এই উপসংহার দৃশ্যটি কতকখানি দায়ী। যেখানে জয়সিংহের মৃত রুধিরাজ দেব দেখে প্রতিমার চরণে আছড়ে পড়ে অপর্ণা চিৎকার করে উঠল “ফিরে দে! ফিরে দে! ফিরে দে!”— সেখানেই যদি অপর্ণা চরিত্রের পরিচয় শেষ হত তাহলে অপর্ণার মধ্যে আমরা স্পন্দমান মানবচিত্তের সর্বোপরি তার নারী হৃদয়ের সত্য রূপটি দেখতে পেতাম এবং সেরূপেই সে আমাদের চিত্তের রসবোধকে বেশি তৃপ্ত করত । কিন্তু শেষ দৃশ্যে সে যখন এসে দাঁড়ালো তখন তার মধ্যে সেই মানব হৃদয়েরবাস্তব রূপটি আর নেই, তখন সে এতো শান্ত, এতো স্থির যেন তার চিত্তের কোন বিকারই কোন কালে হয় নি সে যা ছিল তা-ই রয়ে গেল।
একথা সকলেই জানে যে 'বিসর্জন'-এর মধ্যে একটা প্রত্যয় খুব নিবিড় হয়ে আছে, সমস্ত নাটকটিতে সেই প্রত্যয়টিকে কেন্দ্র করেই হত কিছু সংগ্রাম। পঞ্চমাঙ্কের প্রথম দৃশ্যের সঙ্গে সঙ্গে যদি নাটকটির যবনিকাপাত হত, তাহলে সংগ্রামের শেষে সেই প্রত্যয়টি জয়ী হল কিনা সে খবর আমরা পেতাম না। কিন্তু শেষ দৃশ্যগুলোতে দেখলাম সেই প্রত্যয়টিরই সম্পূর্ণ বিজয়োৎসব। একটা নির্দিষ্ট সত্য প্রতিষ্ঠার একটা নির্দিষ্ট প্রত্যয়ের জয় প্রদর্শনে এই যে প্রয়াস, এটা ‘বিসর্জন'-এর রসবোধ ও অনুভূতির তীব্রতাকে একটু ক্ষুণ্ণ না করে পারে নি। কিন্তু এই ধরনের বিচারের বিরুদ্ধে কিছু যুক্তিও আছে।
প্রথমেই কথা হচ্ছে—পঞ্চমাঙ্কের প্রথম দৃশ্যে অর্থাৎ জয়সিংহের আত্মাহুতি দৃশ্যের সঙ্গে সঙ্গে রঘুপতির চরিত্রের পরিচয় শেষ হতে পারে কি? তাহলে রঘুপতি চরিত্রের চরম পরিণতিটুকু বুঝতে পারা যায় কি? তার ব্রাহ্মণের দৃপ্ত গর্ব হঠাৎ বাধা পেয়ে যে অস্বাভাবিক ক্ষিপ্ততায় নিজেকে একেবারে অন্ধ করে ফেলেছিল। সেই দৃপ্ত গর্ব মাটির ধুলায় লুণ্ঠিত হয়ে চরম ব্যর্থতায় আত্মপ্রকাশ না করলে রঘুপতির সবটুকু পরিচয় যেন কিছুতেই সম্পূর্ণ হয় না। রঘুপতির দৃপ্ত গর্বিত চরিত্র যে প্রচণ্ড বেদনার আঘাতে একেবারে সকল দর্প গর্ব হারিয়ে সকল অহংকার অভিমান জলাঞ্জলি দিয়ে একান্ত দুর্বল অসহায়তার মধ্যে আপন সম্বিত ফিরে পেয়েছিল এবং ধর্মের রহস্যকে জেনেছিল, তার আগেকার চরিত্রের ছায়াটুকুও যে থাকে নি, এটা যেন কিছু অস্বাভাবিক নয়। এ ধরনের জীবনে যেন এরকম পরিণতিই দেখা দিয়ে থাকে। কিন্তু রঘুপতির চরিত্র যে জয়সিংহের বিসর্জন দৃশ্যের সঙ্গে সঙ্গেই শেষ হতে পারে না, এটাই হয়তো তার একমাত্র কারণ নয়।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় জয়সিংহের চরিত্রই বুঝি সকলের অপেক্ষা করুণ রসাত্মক এবং তার বিসর্জন দৃশ্যের মধ্যেই বুঝি নাটকের সমস্ত ট্র্যাজেডিটুকু নিহিত রয়েছে। সে জন্যেই তার বিসর্জন দৃশ্যের সঙ্গে সঙ্গে রঘুপতি চরিত্রের অবসান ঘটলেই নাটকের ট্র্যাজেডিটুকু ভাল করে ফুটতে পারত। জয়সিংহের আত্মদানের ট্র্যাজেডি খুব দৃশ্যময় সেহেতু এরূপ মনে হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু একটু ভাবলেই দেখা যাবে, নাটকের ট্র্যাজেডিটুকু জয়সিংহ চরিত্রের মধ্যে ততটা নয়, যতটা রঘুপতির চরিত্রের মধ্যে। বস্তুত জয়সিংহ চরিত্র অপেক্ষাও গভীরতর ট্র্যাজেডি নিহিত রয়েছে রঘুপতি চরিত্রে এবং সেই ট্র্যাজেডির বিকাশ আরম্ভ হয়েছে জয়সিংহের আত্মদানের পরমুহূর্ত হতে। সে মুহূর্তের পূর্ব পর্যন্তও রঘুপতির একটা ঐশ্বর্য ছিল, এক সুবৃহৎ গর্ব ছিল; তা তার বুদ্ধির অহংকার, যুক্তির অহংকার, বিশ্বাসের অহংকার, ক্ষমতার অহংকার। এই অহংকারই তার সমস্ত সত্তাটাকে ধারণ করে রেখেছিল। কিন্তু জয়সিংহ যে মুহূর্তে তার অহংকারের বেদীমূলে আত্মবিসর্জন দিল সে মুহূর্তেই তার সকল অহংকার চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল, সমস্ত ঐশ্বর্য তার খসে গেল, একটা বিরাট শূন্যতার মধ্যে সে গৃহচ্যুত তারকার মতন কোথায় যে গিয়ে পড়ল তার ঠিকানা নেই। রঘুপতির এই যে একান্ত রিক্ততা, এটাই নাটকের করুণতম ও চরমতম ট্র্যাজেডি। এই ট্র্যাজেডিটুকুর বিকাশ না হলে রঘুপতি চরিত্রের শেষ পরিচয় কিছুতেই আমরা পাই
না।
শুধু এই রঘুপতি চরিত্রের জন্যই পঞ্চমাঙ্কের প্রথম দৃশ্যের পর সমস্ত নাটকটির ওপর যবনিকাপাত আমরা কল্পনা করতে পারলেও সাহিত্য সৃষ্টির দিক হতে হয়ত তা সার্থক হত না। একথা ভুললে চলবে না যে, 'বিসর্জন' শুধু নাটক নহে, তা কাব্যনাট্য, তার একটা কাব্যের দিক আছে, সাহিত্যের দিক আছে। আর শুধু নাটকের দিক হতে দেখলেই জয়সিংহের বিসর্জন দৃশ্যের সঙ্গে সঙ্গে যবনিকাপাত হলে নাটকের কলা-কৌশল একটু ক্ষুণ্ণ হত বলে মনে হয়। কারণ তা হলে একটা বেদনাময় অস্থিরতার মধ্যে নাটকটির সমাপ্তি ঘটত, নাটকীয় কলাকৌশলের দিক হতে তা হয়ত ভাল হত না, রবীন্দ্রনাথও হয়ত তা চান নি। আর চান নি বলেই আখ্যানবস্তুকে একেবারে শেষ যুক্তিসহ পরিণতি পর্যন্ত টেনে নিয়ে একটা স্থির অবিচল শান্তির মধ্যে সমস্ত নাটকটির ওপর যবনিকা টেনে দিয়েছেন, পাঠক অথবা দর্শককে কোন অস্থির চঞ্চল করুণ ব্যথা ভারাক্রান্ত ভাবনার মধ্যে আন্দোলিত হবার সুযোগ দেন নি।
