দীনবন্ধু মিত্রের নীল দর্পণ' নাটকের নায়ক কে এ নাটকের নায়ক চরিত্র কতটা সাফল্য পেয়েছে তা আলোচনা কর
দীনবন্ধু মিত্রের নীল দর্পণ' নাটকের নায়ক কে এ নাটকের নায়ক চরিত্র কতটা সাফল্য পেয়েছে তা আলোচনা কর
![]() |
| দীনবন্ধু মিত্রের নীল দর্পণ' নাটকের নায়ক কে এ নাটকের নায়ক চরিত্র কতটা সাফল্য পেয়েছে তা আলোচনা কর |
উত্তর: বাংলা সাহিত্যের প্রখ্যাত নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্রের 'নীল দর্পণ' (১৮৬০) নাটক বাংলাদেশের নীলচাষ, নীলকরদের অত্যাচার এবং অংশত নীল আন্দোলনের দর্পণ। শুধু নাটক হিসেবে নয়, প্রজাপীড়ন ও নীল আন্দোলনের ভাষ্যরূপেও এ নাটকটির বিশিষ্ট ভূমিকা রয়েছে। ‘নীল দর্পণ' বাংলা গণনাটকের সূতিকাগারও বটে।
কোন নাটকে যে বিশিষ্ট চরিত্র সকল ঘটনার কেন্দ্রে অবস্থান করে কাহিনী ও বিভিন্ন চরিত্রকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং কাহিনীতে যার Doing (সক্রিয়তা) এবং Suffering (ভোগান্তি) সবচেয়ে বেশি, সে-ই উক্ত নাটকে নায়ক চরিত্রের মর্যাদা পায়। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় ও নায়ক চরিত্র অভিন্ন হয়ে থাকে। দীনবন্ধু মিত্রের 'নীল দর্পণ' উদ্দেশ্যমূলক নাটক। এ নাটকটি বাংলার কৃষকের উপর নীলকরদের অত্যাচার এবং নীলকরদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রত্যয়ে সংক্ষুব্ধ— ফলে এ নাটকের নায়ক কোন বিশেষ ব্যক্তি নয় এবং একদঙ্গল নিপীড়িত কৃষকই এ নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র। তবে নাট্যকারের একটি বিশেষ দরদ নবীন মাধবের প্রতি লক্ষণীয়। তাই মনে হয় যে নাট্যকার নবীন মাধবকেই নাটকে নায়কের আসনেবসাতে প্রয়াস পেয়েছেন ।
স্বরপুর গ্রামের বর্ধিষ্ণু কৃষক গোলোক বসুর জ্যেষ্ঠ পুত্র নবীন মাধব। সে পরোপকারী, ন্যায়বান, পিতৃভক্ত, দরিদ্র কৃষকদের রক্ষায় তার জীবন উৎসর্গীকৃত। পরদুঃখকাতরতা ও তেজস্বিতা নবীন মাধবের অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। নীলকরগণ কৃষকদেরকে জোর করে দাদন দিয়ে ভাল ভাল জমিতে নীল চাষের সব রকম চেষ্টা চালাতো। নবীন মাধব কৃষকদের উপরে নীলকরদের এই অন্যায় অবিচারের প্রতিবাদ করেছে, এমনকি অসহযোগিতার কথাও ঘোষণা করেছে।
কৃষকের প্রতি সহমর্মিতার সাথে সাথে তাদের কল্যাণার্থে নবীনমাধবের বুকে সাহসেরও কমতি নেই। সাধুচরণের কথায় আমরা তার সাহসিকতার বিষয়টি জানতে পাই- “বড়বাবুর কিন্তু ভ্যালা সাহস।” তিনি সাহেবকে স্পষ্ট বলেছেন- আমার গত সনের ৫০ বিঘা নীলের দাম চুকাইয়া না দিলে এ বৎসর এক বিঘাও নীল করিব না, এতে প্রাণ পর্যন্ত পণ, বাড়ী কি ছার।"
নবীন মাধব কুঠিয়ালদের থোরাই কেয়ার করে। ক্ষেত্রমণির মায়ের কাছে যখন সে শুনতে পায় যে তাকে নীলকরদের কুঠিতে ধরে নিয়ে গেছে, তখন সে বলেছে, পিতার স্বরপুর বৃকোদর জীবিত থাকিতে কুলকামিনী অপহরণ! এই মুহূর্ত্তেই যাইব- কেমন দুঃশাসন দেখিব, সতীত্ব শ্বেত উৎপলে নীলমণ্ডূক কখনই বসিতে পারিবে না।” এবং শেষ পর্যন্ত তোরাপের সহায়তায় সে রোগ সাহেবের কক্ষ থেকে নির্যাতিতা ক্ষেত্রমণিকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে।
শুধু নিজের স্বার্থ সংরক্ষণে নয় গ্রামবাসীর স্বার্থের বিষয়েও সে সাহেবদের কাছে অনুনয়ও করেছে, “আমি আপনাকে ৫০ টাকা সেলামি দিতেছি, এ বৎসর এ স্থানটায় নীল করবেন না।” কিন্তু কুঠিয়াল সাহেব তার পায়ের জুতা নবীন মাধবের হাঁটুতে ঠেকালে নবীন মাধবের চক্ষু রক্তবর্ণ হল, অঙ্গ থরথর করে কাঁপতে লাগল, দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়াতে লাগল এবং সজোরে সাহেবের বুকে এমন একটি পদাঘাত করল যাতে সাহেব চিৎ হয়ে পড়ল ।নবীন মাধব যে পরোপকারী তার প্রমাণ মেলে মুসলমান কৃষক তোরাপের কথায়-
তোরাপ ঃ ম্যারে ক্যান ফ্যালায় না, মুই নেমোখ্যারামি কত্তি পারবো না- ঝে বড়বাবুর জন্যি জাত বাঁচেচে, ঝার হিল্লেয় বসতি কত্তি নেগিচি, ঝে বড়বাবু হাল গোরু বিচিয়ে নে
ব্যাড়াচ্চে, মিত্যে সাক্ষী দিয়ে সেই বড়বাবুর বাপকে কয়েদ করে দেব? মুই তো কখনুই
পারবো না- জান কবুল ।
এরকম খণ্ড খণ্ড ঘটনার মধ্য দিয়ে নবীনমাধবের বীরত্ব, দেশহিতৈষণা, সহমর্মিতা ও নির্ভীকতার পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু আনুপূর্বিক সঙ্গতি রক্ষা করে চরিত্রটি অখণ্ড রূপ পায় নি। ফলে চরিত্রটি জীবন্ত না হয়ে কৃত্রিম, আদর্শায়িত ও বাক সর্বস্ব হয়ে উঠেছে। সমগ্র কাহিনীর মেজাজে নবীন মাধব বলিষ্ঠ ও দ্বিধাহীন নয়।
নবীনমাধবের চরিত্রে যে সব গুণ ছিল তা যথাযথ প্রস্ফুটিত হলে তাকে নায়ক বলা যেত, কিন্তু নাট্যকার তার যথার্থ বিকাশ সাধনে ব্যর্থ হয়েছেন। তার কোন আচরণই নাট্যিক ক্রিয়ার ভিতর দিয়ে প্রত্যক্ষ হয়ে ওঠে নি, কেবল মৌখিক বক্তৃতা বা পরোক্ষ ভাষণের মাধ্যমে প্রকাশ ঘটেছে। তার নায়কোচিত সাহসিকতা অন্যের মুখে প্রকাশ পেয়েছে। নাটকীয় আচরণের ভিতর দিয়ে তার সাহসিকতা প্রকাশ না পেয়ে তা পরের মুখ দিয়ে প্রকাশ করায় নবীন মাধবের নায়কোচিত গুণ বিনষ্ট হয়েছে। তাছাড়া সাহেবের আক্রমণে মৃত প্রায় নবীন মাধবকে গৃহে এনে সাধুচরণ সাহেবের কুঠিতে সংঘটিত সুদীর্ঘ ঘটনার একটি মৌখিক বিবরণ দিয়েছে। বিবরণটি নাটকীয় ঘটনায় পরিপূর্ণ। ঘটনাটি নাটকীয় দৃশ্যের ভিতর দিয়ে প্রত্যক্ষ হয়ে উঠলে নবীনমাধবের নায়কোচিত গুণ প্রকাশ পেত। নাট্যকার দৃশ্যগুণ পরিত্যাগ করে কেবল শ্রব্য করে তুলতে প্রয়াস পেয়েছেন। ফলে নায়ক চরিত্রের গৌরব প্রকটিত হয় নি।
নাট্যকার গোলকবসু নবীনমাধবের কাহিনীকে নাটকের মূল কাহিনী হিসেবে গ্রহণ করে সাধুচরণ ক্ষেত্রমণির কাহিনীকে পার্শ্বকাহিনী হিসেবে ব্যবহার করেছেন। অথচ নাট্যকার ‘নীল দর্পণ' নাটক রচনার প্রেরণা পেয়েছেন সাধুচরণ ক্ষেত্রমণির মতো লাঞ্ছিত কৃষক পরিবারের হাহাকার থেকে । তাই স্রষ্টা দীনবন্ধু মিত্র তাঁর সৃষ্ট নবীন মাধবের মতো একজন মধ্যবিত্ত আদর্শবান যুবকের মধ্যে সৃষ্টির আনন্দ খুঁজে পান নি বলেই সংঘাত ও জটিলতার মধ্য দিয়ে নবীন মাধবের চরিত্রকে বিকশিত করতে পারেন নি। বরঞ্চ পূর্ব পরিকল্পিত কতকগুলো বিশিষ্ট ঘটনার মধ্যে সন্নিবেশ করার ফলে চরিত্রটি কৃত্রিমতা দোষে দুষ্ট হয়ে নায়কত্বের দাবিকে দুর্বল করে ফেলেছে। নাটকের নায়ক চরিত্র নিজেই গতিশীল চরিত্র হয়ে যেমন সমগ্র নাটকের কাহিনীকে একটি নির্দিষ্ট পরিণতির দিকে অগ্রসর হতে সহায়তা করে, তেমনি সমগ্র নাটকটিকেও গতিশীল করে তোলে। 'নীল দর্পণ' নাটকে নবীন মাধবকে দিয়ে নাট্যকার এর কোনটিও সমাধা করতে সমর্থ হন নি।
‘নীল দর্পণ' নাটকের কাহিনীতে সামগ্রিকভাবে একটি সমাজের সাধারণ একটি বিপর্যস্ত অবস্থা বর্ণনাকে লক্ষ্য করা হয়েছে, তাই তার মধ্যে বিশেষ কোন একটি চরিত্র বিশেষত্ব লাভ করে নায়কের প্রাধান্য লাভ করে উঠতে পারে নি। চরিত্র সৃষ্টিতে নাট্যকার যে সার্থকতাই লাভ করুন না কেন, কোন একক চরিত্র অবলম্বন করে তার সেই সার্থকতা নাটকে প্রকাশ করতে পারেন নি।
নায়কত্বের বিষয়ে নবীন মাধবকে নিয়েই যেখানে এত সংশয়, সেখানে অন্য কোন চরিত্রের দাবি একেবারেই টেকে না। কারণ এ নাটকে প্রকৃত অর্থে একটিও সংগ্রামশীল চরিত্র নেই। অলঙ্কার শাস্ত্রের নির্দেশনা বাদ দিলেও নাটকের নায়ক অর্থে আমরা সেই চরিত্রকে বুঝি, যার Doing ও Suffering সমগ্র নাটকের ভিত্তি বা মূল প্রতিপাদ্য রূপে বর্ণিত হয়ে থাকে। এ নাটকে কৃষকদের দারুণ দুর্ভাগ্য প্রধান বর্ণনীয় বিষয়। নবীনমাধবের Doing s Suffering থাকলেও এর কোনটাই নাটকে বড় একটা স্থান করে নেয় নি। নবীনমাধবের বিশিষ্ট কীর্তি অপেক্ষা নিদারুণ অক্ষমতাই প্রকট হয়েছে। নবীন মাধব এ নাটকের ভিত্তি বা ধারণ স্তম্ভ নয়, নাটকে প্রবাহিত ঘটনা স্রোতের অল্প ক্ষেত্রই সে অধিকার করেছে। এ নাটকে নায়ক স্পষ্ট হয় নি। নাটকের দ্বন্দ্ব, সংঘাত, ঘটনাস্রোত বিশেষ কোন চরিত্রকে আবর্তন করে ঘটে নি। তবুও সামগ্রিক বিচারে নায়কত্বের দাবি কেউ করলে তা নবীন মাধব। নবীন মাধব উচ্চবিত্ত। ইংরেজি সভ্যতার প্রচণ্ড প্লাবনে সমাজের উপরিস্তরে চিন্তার ও ভাবের জগতে যে পরিবর্তন এসেছিল, তা তখনো কোন স্থির রূপ লাভ করে নি, তাই উচ্চস্তরের পরিবর্তনশীল অবস্থায় নাট্যকার নির্দিষ্ট কোন মান খুঁজে পান নি। তাকে নিজস্ব কল্পনার আশ্রয়ে এ চরিত্র গঠন করতে হয়েছে।
নবীন মাধব লেখকের কামনাগত আদর্শ বলে তার চরিত্র সর্বাঙ্গসুন্দর, নির্দোষ লেখকের কামনার মোক্ষধামে তার অবস্থান। নবীন মাধব লেখকের প্রীতি প্রতিম। ফলে সে মায়ের দুলাল, পিতার নয়নমণি, পত্নীর কণ্ঠহার, গ্রামের মানুষের প্রিয়। এসব বৈশিষ্ট্য তাকে প্রীতিভাজন করে তুলেছে, কিন্তু নাটকের নায়ক করে তোলে নি।
তবে উপসংহারে বলা যায় যে-
গণনাটকু হিসেবে ‘নীল দর্পণ' নাটকের নায়ক একা কেউ নয়- এ নাটকের নায়ক একটি দল, নবীন মাধব সেই দলের দলপতি।
