জঙ্গনামা কী সংক্ষেপে আলোচনা কর

জঙ্গনামা কী? সংক্ষেপে আলোচনা কর।

জঙ্গনামা কী? সংক্ষেপে আলোচনা কর।
জঙ্গনামা কী? সংক্ষেপে আলোচনা কর।

উত্তর: মধ্যযুগের শেষপাদে মুসলমান কবি কর্তৃক বাংলা, হিন্দি, তুর্কি, আরবি, ফারসি শব্দ মিশ্রিত এক ধরনের বিশেষ কাব্য রচিত হয়েছে, এ কাব্যগুলো দোভাষী পুঁথিসাহিত্য নামে পরিচিত। দোভাষী পুঁথি সাহিত্যের পাঁচটি ধারা। এ ধারাগুলোর মধ্যে যুদ্ধকাব্য অন্যতম। 

এ কাব্যগুলোতে ইসলাম ধর্ম প্রচারকদের যুদ্ধ কাহিনী প্রচারিত হয়েছে। এসব যুদ্ধকাব্যে রোমান্সের তথা প্রণয় রসের অবতারণা থাকলেও এগুলো মূলত জেহাদী প্রেরণার কাব্য ।

আরবিতে যা মাগাজী, ফারসিতে তাই জঙ্গ, সংস্কৃতে যুদ্ধ, বাংলায় লড়াই। নিজের নিরাপত্তা সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হয়ে অন্যদের যুদ্ধ দেখা, তার বর্ণনা শোনা সুখকর। যুদ্ধ মানব সমাজে চলছে- চলবে। স্বচ্ছ ও সুস্থ মানুষের চেতনার গভীরে জীবনের যা মূল প্রেরণা তা হচ্ছে জিগীষা। 

আত্মপ্রত্যয়ী মানুষ বাস্তবে এ জিগীষা চরিতার্থ করে, আত্মপ্রত্যয়হীন দুর্বল মানুষ বিকৃত উপায়ে তা অনুভব, উপভোগ করেই তুষ্ট থাকে। 

বিভিন্নভাবে অপরকে উপকৃত করে ঋণী ও কৃতজ্ঞ রেখেই সাধারণ মানুষ জিগীষা পূরণ করে, অন্যেরা গুণে-মানে- মাহাত্ম্যে শ্রেষ্ঠতর হয়ে বা ধনবলে, জনবলে, বাক্যবলে, জ্ঞানবলে অতুল্য হয়ে কর্মে ক্রীড়ায়- কৌশলে নৈপুণ্যে-উৎকর্যে অনন্য অজেয় হয়ে মানুষ বিজয়ানন্দ অনুভব করে। 

আর রাজতন্ত্রের যুগে দিগ্বিজয়ী রাজারা, সেনারা প্রতিপক্ষের সাথে বাহুবলে বা অস্ত্রযোগে লড়ে জয়ী হয়ে বিজয় গৌরব উপভোগ করত।

আজও ব্যক্তিক, পারিবারিক, সাম্প্রদায়িক জাতিক, রাষ্ট্রিক জীবনে লড়াই-ই জীবনের জয়- পরাজয় নির্ধারণ করে। এ লড়াইয়ের নাম প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা। ধনের, মানের, যশের, কথার, ক্ষমতার, ভোগের, চিন্তার, মতের লড়াই চলছে সর্বদা ও সর্বথা। জেতাই লক্ষ্য। 

তাই লড়াই করতে করাতে নয় শুধু, লড়াই দেখতেও সুখ। যেখানে প্রতিযোগিতা, যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, যেখানে যুদ্ধ সেখানেই মানুষের উৎসুক দৃষ্টি নিবদ্ধ। 

তাই যুদ্ধকাব্য লোকপ্রিয়, পৃথিবীর প্রাচীন মহাকাব্যগুলো নয় কেবল, রূপকথাগুলোও রাজকুমারদের প্রাণপণ সংগ্রামের, বিপন্ন নায়কের সঙ্কট উত্তরণের এবং বিরুদ্ধ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ইতিকথা। সাহিত্যেও শৃঙ্গাররসের পরেই বীররসের স্থান।

জঙ্গনামা বা যুদ্ধকাব্যের মধ্যে কারবালা যুদ্ধকাব্যই ষোল-সতেরো শতক থেকে বাংলার মুসলিম সমাজে বিশেষ জনপ্রিয়। রাসূলের নাতি বলেই মুসলিম মাত্রই হাসান-হোসেনের ভক্ত সমর্থক এবং মুয়াবিয়া-এজিদের নিন্দক হোসেন এজিদের বশ্যতা স্বীকার করলে অনুগত থাকার অঙ্গীকার করলে ভোগ-উপভোগের স্বস্তিকর নিশ্চিত জীবন সুখে কাটাতে পারতেন। 

কিন্তু মান ও স্বাধিকার রক্ষার জন্য প্রাণ দেওয়াকেই শ্রেয় জ্ঞান করেন। ফারসি কাব্য অবলম্বনে ফকির গরীবুল্লাহ সর্বপ্রথম বাংলায় 'জঙ্গনামা' কাব্য রচনা করেন। কাব্যের বিষয়বস্তু কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনা। মহানবীর প্রিয় দৌহিত্র ইমাম হোসেন কারবালা প্রান্তরে নির্মমভাবে সঙ্গী-সাথীসহ ১০ই মোহররম নিহত হয়েছিলেন। 

এ মর্মান্তিক কাহিনীকে কেন্দ্র করে, এর সাথে কল্পিত নানা ঘটনা ও চরিত্র যোগ করে রচিত হয়েছিল 'জঙ্গনামা'। যেহেতু ইমাম হোসেনের শাহাদাতের ঘটনা নিয়েই 'জঙ্গনামা', তাই সাধারণ মুসলমান সমাজে এর অত্যধিক কদর ছিল। 

এ জন্যে তখনকার সময়ে একাধিক ব্যক্তি 'জঙ্গনামা' কাব্য রচনা করেছিলেন। মকতুল হোসেন' কাব্যও 'জঙ্গনামার ই আরেক নাম। এ ধারায় যাঁরা কাব্যচর্চা করেছেন তাঁরা হলেন- মোহাম্মদ খান, হায়াত মাহমুদ, সফিউদ্দিন প্রমুখ।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ