নীল দর্পণ' কি উদ্দেশ্যমূলক নাটক এ বিষয়ে তোমার অভিমত ব্যক্ত কর

নীল দর্পণ' কি উদ্দেশ্যমূলক নাটক এ বিষয়ে তোমার অভিমত ব্যক্ত কর 

নীল দর্পণ' কি উদ্দেশ্যমূলক নাটক এ বিষয়ে তোমার অভিমত ব্যক্ত কর
নীল দর্পণ' কি উদ্দেশ্যমূলক নাটক এ বিষয়ে তোমার অভিমত ব্যক্ত কর 

 উত্তর :দীনবন্ধু মিত্র (১৮৩০-১৮৭৩) বাংলা নাট্য সাহিত্যের প্রথম মাটির কাছাকাছির শিল্পী। সমকালীন শিল্পীদের মধ্যে তিনি ছিলেন মানবদরদি ও স্পষ্টবাদী ও অকুতোভয়। তাঁর শ্রেষ্ঠ নাটক 'নীল দর্পণ'। এ নাটক বাংলাদেশের নীলচাষ, নীলকরদের অত্যাচার এবং অংশত নীল আন্দোলনের দর্পণ। 

শুধু সাহিত্যকর্ম হিসেবেই নয়, প্রজাপীড়নও নীল আন্দোলনের ভাষ্যরূপে এ নাটকের একটি বিশিষ্ট ভূমিকা রয়েছে। এ নাটকের কাহিনীতে বাংলার কৃষকদের ওপর নীলকরদের অত্যাচারের চালচিত্র চিত্রিত হয়েছে।নীলকররা নীলচাষকে কেন্দ্র করে বাংলার কৃষকদের ওপর দীর্ঘদিন যাবৎ অত্যাচার করে আসছে, কিন্তু দীনবন্ধু মিত্রের পূর্বে এ বিষয়টি নিয়ে সুস্পষ্টভাবে কেউই সাহিত্য রচনা করেন নি।

 দীনবন্ধু মিত্র নাটকের ভূমিকায় লিখেছেন- “নীলকর নিকর করে নীল দর্পণ অর্পণ করিলাম। এক্ষণে তাঁহারা নিজ নিজ মুখ সন্দর্শন পূর্বক তাঁহাদিগের ললাটে বিরাজমান স্বার্থপরতা কলঙ্কতিলক বিমোচন করিয়া তৎপরিবর্তে পরোপকার শ্বেত চন্দন ধারণ করুণ তাহা হইলেই আমার পরিশ্রমের সাফল্য, নিরাশ্রয় প্রজাদের মঙ্গল। তোমরা যে সাবিশয় অত্যাচার দ্বারা বিপুল অর্থ লাভ করিতেছে, তাহা পরিহার কর, তাহা হইলে অনাথ প্রজারা সপরিবারে অনায়াসে কালাতিপাত করিতে পারিবে।”লেখকের উপর্যুক্ত বক্তৃতা থেকে সুস্পষ্ট যে, তিনি নিরাশ্রয় কৃষকসমাজকে নীলকর সাহেবদের অত্যাচার ও অবিচারের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যই নাটকটি লিখেছেন । 

অর্থাৎ 'নীল দর্পণ' নাটক রচনার উদ্দেশ্য এদেশের কৃষককুলের মঙ্গল সাধন।নীল ব্যবসা লাভজনক বলে বাংলার বিভিন্ন স্থানে নীলকুঠি গড়ে ওঠে। বাংলার জমি নীল চাষে বিশেষ উপযোগী। তাই নিরীহ কৃষকদেরকে নীলের দাদনে বাধ্য করা হতো। নীলকরদের জবরদস্তিতে নীলচাষ করতে বাধ্য হলেও কৃষকেরা উচিত মূল্য পেত না। নীলচাষে অসম্মত কৃষকদের ধরে এনে চাবুকে শায়েস্তা করা হতো, ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে, যুবতী কন্যা বা সুন্দরী স্ত্রীকে ধরে এনে তাদের সম্ভ্রম নষ্ট করা হত।নীলকরদের ক্ষমতা ও অত্যাচারে বাংলার মাটি হয়েছে কম্পিত ও কলঙ্কিত।

 তাদের লালসার লেলিহান শিখায় শতসহস্র কৃষক জীবন হারিয়েছে, ঘরবাড়ি হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছে। বাংলার নারী হারিয়েছে তাদের সম্ভ্রম। নীলকরদের বিলাসের হোলি খেলায় রক্তে রঞ্জিত হয়েছে বাংলার পথ প্রান্তর। তাদের তাণ্ডব নৃত্যের ঝাপটায় নিভে গেছে কত প্রাণ প্রদীপ। নিপীড়িত মানবতার ক্রন্দনরোলে আকাশ বাতাস শান্ত ও ম্লান হলেও নীলকর শোষকদের হৃদয় টলে নি।নীলকরদের অমানুষিক নির্যাতন বাংলার বৃহত্তর জনসাধারণের মনে প্রতিশোধের এষণা জাগিয়ে তুলেছিল। কিন্তু তারা প্রতিকারের কোন পথ পায় নি। এ সময়ে 'নীল দর্পণ'নাটকের প্রকাশ বঙ্গ সমাজে তুমুল আন্দোলন তুলেছিল।

 ‘নীল দর্পণ” এর সমকক্ষ কোন গ্রন্থ নেই যা সমাজকে এতটা প্রকম্পিত করেছিল। বাসাতে বাসাতে “ময়রানী লো সই নীল গেজেছ কই?” ইত্যাদি দৃশ্যের অভিনয় চলেছে।মধুসূদন দত্ত অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে নাটকটির ইংরেজি অনুবাদ সম্পন্ন করেন। নীলকর অত্যাচারের প্রকৃত স্বরূপ এ নাটকে প্রকাশিত হওয়ায় তা এদেশীয় ও ইংল্যান্ডের শাসন কর্তাদের গোচরে আনার মানসে রেভারেন্ট জেমস লঙ গ্রন্থটি প্রকাশ করেন এবং সে জন্য তাকে মানহানির মামলায় দণ্ড ভোগ করতে হয়। এই অভাবনীয় ঘটনায় ‘নীল দর্পণ’ নাটকের নাম অল্প কালের মধ্যেই অপ্রত্যাশিত রূপে প্রচার লাভ করে।'নীল দর্পণ' সমসাময়িক কালে যথেষ্ট আলোড়ন তুলেছিল। অর্থাৎ নাটকটি সাময়িক উদ্দেশ্য সাধনে সার্থক ভূমিকা পালন করেছিল। কিন্তু নীলচাষ, নীল হাঙ্গামা ও নীল আন্দোলন আজ ইতিহাসের বস্তুতে পরিণত হলেও ‘নীল দর্পণ' নাটক সাময়িকতাকে অতিক্রম করে এ যুগেও পাঠক-দর্শক মনে আবেদন সৃষ্টিতে সমর্থ হয়েছে।

 নাট্যকার জীবনধারা ও জীবনসঙ্গের গভীরে প্রবেশ করে নাটকটির চরিত্রগুলোকে এমনভাবে সৃষ্টি করেছেন যে, সেগুলো সাময়িকতার গণ্ডি অতিক্রম করে চিরন্তন তার ঔজ্জ্বল্যে ভাস্বর হয়ে উঠেছে।বিদেশি নীলকরদের অত্যাচার ও অবিচারের রূপকে পরিস্ফুট করে তুলতে নাট্যকার, গোলকবসু ও সাধুচরণের পরিবারের মর্মন্তুদ কাহিনীকে নাটকটিতে প্রধান করে তুলেছেন। নীলকর উড এবং রোগ সামান্য দাদনে উভয় পরিবারকে নীলচাষে বাধ্য করেছে। দাদনে অসম্মতি জানালে সাধুচরণ ও তার ভাই রাইচরণকে কুঠিতে বন্ধ করে তাদের ওপর দৈহিক নির্যাতন চালিয়েছে।

 অত্যাচারিত কৃষকদের প্রতি সহানুভূতি ও সমর্থন জানানোর কারণে বসু পরিবার নীলকরদের কারণে মহাশ্মশানে পরিণত হয়েছে।বসু পরিবার ও সাধুচরণ পরিবারের প্রতি নীলকরদের এই নির্মম অত্যাচার মূলত সে যুগের একটি সামাজিক সমস্যাকেই সুস্পষ্ট করে তোলে। বাংলার শত শত কৃষক পরিবারের প্রতিনিধিত্ব করেছে এই পরিবার দুটো।

 মূলত নাট্যকার এই সমস্যার মধ্যে তাঁর দৃষ্টিকে আবদ্ধ না রেখে মানবজীবনের শাশ্বত আশা আকাঙ্ক্ষা ও ব্যথা-বেদনায় আলোড়িত হয়ে ব্যক্তি চরিত্রের রূপ ও রহস্যকেই উদ্ঘাটিত করেছেন। তাই নিরক্ষর মুসলমান কৃষক তোরাপ আদিম প্রাণ প্রাচুর্যে ভরপুর এক বলিষ্ঠ কৃষক চরিত্র হিসেবে বাংলা সাহিত্যে অমরত্বের মর্যাদা লাভ করেছে। সাধুচরণের কন্যা ক্ষেত্রমণি শুধু নীলকর রোগ সাহেবের লালসার অগ্নিতে দগ্ধ একজন কিশোরী নয়, সে পুরুষের লালসার থাবায় ক্ষতবিক্ষত অসহায় নারী জাতির মূর্ত প্রতীক। 

“মুই সোনার নক্কি ভেসয়ে দিতে পারবো না মা রে, মুই কনে যাব রে- সাহেবের সঙ্গি থাকা যে মোর ছিল ভাল মা রে, মুই মুখ দেখে জুড়োতাম মা রে।”- এ শুধু ক্ষেত্রমণির মৃত্যুতে রেবতীর ক্রন্দন নয়, সন্তানের মৃত্যুতে চিরন্তন মাতৃহৃদয়ের আকুল আর্তি।নীলকরদের অত্যাচারের শিকার নিপীড়িত কৃষকের প্রতি নাট্যকারের গভীর মমত্ব ও সহানুভূতির জন্য তাঁর অঙ্কিত চরিত্র নবীন মাধব, রাইচরণ, তোরাপের মাধ্যমে অত্যাচারী নীলকরের প্রতি ঘৃণা ও আক্রোশ প্রকাশ করেছেন। নাটকে গোলকবসু, সাধুচরণের দুর্ভাগ্য ও হাহাকারের করুণ চিত্রের মধ্য দিয়ে সমকালীন নিষ্পেষিত হতভাগ্য কৃষকদের চালচিত্র উঠে এসেছে। তদুপরি, নীল দর্পণই প্রথম সমাজবাস্তবতার নিরিখে রচিত নাটক এবং গণমানুষের আন্দোলনের সূতিকাগার।

এতদসত্ত্বেও সমসাময়িক ঘটনার কাদামাটি 'নীল দর্পণ' নাটকে লেগে থাকলেও এ নাটকে কোন কোন ক্ষেত্রে চিরন্তন জীবন সত্যের সার্থক বিকাশ ঘটেছে। তাই 'নীল দর্পণ' উদ্দেশ্যমূলক নাটক হলেও উদ্দেশ্য সর্বস্বতা এর ধর্ম নয়। 'নীল দর্পণ' একটি বিশেষ সময়ের সামাজিক ও রাজনৈতিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে রচিত হলেও যুগাতীত, চিরন্তন ও সর্বজনগ্রাহ্য উপাদানের অভাব এ নাটকে নেই। নীলকর-নীলচাষ কোন কিছুই এ সমাজে নেই, কিন্তু ‘নীল দর্পণ' নাটকের আবেদন আজও অম্লান। সুতরাং অনস্বীকার্য যে, নাটকটি সাময়িক উদ্দেশ্য সাধন করেও সাময়িকতার সীমাকে অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ