কাহ্নপা কে ছিলেন চর্যাগীতি অবলম্বনে তাঁর কবি প্রতিভা আলোচনা কর
কাহ্নপা কে ছিলেন চর্যাগীতি অবলম্বনে তাঁর কবি প্রতিভা আলোচনা কর
অথবা, চর্যার সর্বোচ্চ পদকর্তার জীবন ও কর্ম আলোচনা কর
অথবা, কাহ্নপার সংক্ষিপ্ত জীবন ও সাহিত্যকর্ম বিশ্লেষণ কর
![]() |
| কাহ্নপা কে ছিলেন চর্যাগীতি অবলম্বনে তাঁর কবি প্রতিভা আলোচনা কর |
উত্তর : বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদের কবিগোষ্ঠীর মধ্যে কাহ্নপা বা কানুপা শ্রেষ্ঠ। কাহ্নপা চর্যাপদের সর্বোচ্চ সংখ্যক পদের রচয়িতা। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, কাহ্নপা ৬৭৫ থেকে ৭৭৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। কারো কারো মতে, তাঁর জীবনকাল ৮৪০ খ্রিষ্টাব্দের কাছাকাছি সময়ের রাজা দেবপালের শাসনামলে। কাহ্নপা ছিলেন কর্ণাটকবাসী।
নালন্দায় লেখাপড়া করতে এসে তিনি আর নিজ অঞ্চলে ফিরে যাননি। তিনি বাংলার পাহাড়পুরে অবস্থিত বৌদ্ধবিহারেও বাস করতেন বলে ধারণা করা হয়। নালন্দায় শিক্ষা সমাপন করে তিনি বাংলার বিভিন্ন অল থেকেছেন ও জ্ঞান বিতরণ করেছেন। তিনি ছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় জ্ঞানী। কাহ্নপা বা কানুপা বাংলা ভাষার আদিকবিদের মধ্যে অন্যতম।
তিনি ভেরোটি পদ রচনা করেছেন। এগুলো সংকলিত আছে বাংলা ভাষার প্রাচীনতম গীতিসংগ্রহ 'চর্যাশ্চর্যবিনিশ্চয়'এ। ভণিতায় কাহ্ন, কাহ্নিলা, কাহিল প্রভৃতি ভিন্ন ভিন্ন ভাবে তাঁর নামের উল্লেখ আছে। তবে কাহ্ন নামাঙ্কিত গানগুলো সব একই ব্যক্তির রচনা নয় বলে পণ্ডিতদের অভিমত। আলোচ্য প্রবন্ধে আমরা কাহ্নপার সংক্ষিপ্ত জীবন ও কর্ম বিশ্লেষণের প্রয়াস পাব।
চর্যাপদ একটি সংকলন গ্রন্থ। কানুপার সর্বাধিক পদ এ গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। এতেই কবির জনপ্রিয়তা প্রমাণিত হয়। তিনি কত সংখ্যক পদ রচনা করেছিলেন, আজ তার সন্ধান পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে তাঁর বাছাই করা পদগুলো গীতিসংকলনে স্থান পেয়েছিল এ কথা সত্য। 'কাহ্নপাদগীতিকা' নামে তাঁর একটি গীতিসংকলন ছিল। কেউ কেউ অনুমান করেন চর্যার কাহ্নপাদের গীতিগুলো সেখান থেকে সংগৃহীত হয়েছিল। চর্যাপদগুলো গীতাকারে রচিত।
প্রত্যেক পদের শেষে রাগের উল্লেখ আছে। কাহ্নপার তেরোটি পদে মোট ছটিতে বিভিন্ন রাগের নাম আছে, যথা : পটমঞ্জরী, দেশাখ, ভৈরবী, কামোদ, গউড়া, মালসী গবুড়া। সংস্কৃত সংগীতশাস্ত্রে রাগগুলোর বিবরণ আছে। কেবল গউড়া দেশি রাগ হতে পারে। কাহ্নপা যে সংগীত বিশারদ ছিলেন, এতে তাই প্রমাণিত হয়।
প্রাচীন যুগের কবিদের ব্যক্তি পরিচয় নির্ণয় করা দুঃসাধ্য। তাঁদের রচনার ভণিতা থেকে কেবল নাম জানা যায়। ভণিতা লেখার রীতি না থাকলে তাও সম্ভব হতো না। এ ক্ষেত্রে পরোক্ষ সূত্র থেকে কবির ব্যক্তিজীবনের তথ্য অনুসন্ধান করতে হয়।
জ্ঞানমার্গীয় সহজ সাধনা সিদ্ধাচার্যদের লক্ষ্য ছিল। এ ব্যাপারে চর্যাগীতি ও দোহাকোষে কবির একই মনোভাব ব্যক্ত হয়েছে। সুতরাং উভয় রচনা একই কবির হওয়া সম্ভব। কাহ্নপাদ দোহার টীকাভাষ্য নিজেই লিখেছেন। চর্যাগীতি ও দোহাকোষের কাহ্নপাদ একই ব্যক্তি হলে তিনি সংস্কৃত, অপভ্রংশ ও বাংলা তিনটি ভাষায় দক্ষ ছিলেন।
কানুপার প্রতিটি এক বা একাধিক ভণিতা আছে, কোনো ভণিতা ধ্রুপদে, কোনো ভণিতা শেষ পদে। বিভিন্ন চর্যায় কাহ্নপার নিম্নরূপ ভণিতা পাওয়া যায় :
১. তা দেখি কাহ্ন বিমনা ভইলা ।
৪. কাহ্নু বিলসই আসবমাতা।৭ নং চর্যা ৯ নং চর্যা
৫. নিখিন কাহ্ন কাপালি জোই লাগ
৬. কাহ্ন কাপালী জোই পইঠ পচারে ৭. চলিল কাহ্ন মহাসুহ সাঙ্গে।
৮. ভণ কইসে কাহ্নু নাহি- ১০ নং চর্যা- ১১ নং চর্যা- ১৩ নং চর্যা-৪২ নং চর্যা
ভণিতার ভাষণ থেকে কবিকে সামান্যই জানা যায়। কবির নামের বানানের ভেদ আছে-কাহ্ন, কাহ্নু, কাহি, কাহিল। ১২ নং চর্যায় কাহ্নু হলেন-'কাপালী জোই' বা কাপালিক যোগী। ৪২ নং চর্যাতেও 'কাহিল জোই' তথা কাহিল যোগীর উল্লেখ আছে। ৩৬ নং চর্যার ভণিতায় কাহিল 'লাঙ্গা যোগী ছিলেন। ১৯ নং চর্চার ভণিতায় কাহন- ডোম্বীর বিয়ের সংকেত আছে।
ভণিতা ছাড়া পদগুলো পাঠ করেও কবি সম্বন্ধে কিছু তথ্য উদ্ধার করা যায়। ৩৬ নং পদে কবির শুরু হিসেবে 'জালম্বরীপা' এর উল্লেখ আছে। কবি লিখেছেন :
ড. সুকুমার সেমন এর অনুবাদ করেছেন-
শাখি করিব জালস্করি-পাত্র।
পাখি না রাহঅ মোরি পাণ্ডিআচাএ
জালন্ধরি পাদকে সাক্ষী করিব। আমাকে ছাড়া পণ্ডিতাচার্য রয় না ॥
গৌড়ীয় অবহট্ঠ ভাষায় রচিত একাধিক দোহাকোষের সন্ধান পাওয়া গেছে। একটি দোহাকোষের রচয়িতা কৃষ্ণাচার্যপাদ। হরপ্রসাদশাস্ত্রী 'বৌদ্ধগান ও দোহা' গ্রন্থে কৃষ্ণাচার্য ও সরজবস্ত্রের দোহাকোষ সম্পাদিত করে প্রকাশ করেছেন। তিনি কাহ্নুপাদ তথা কৃষ্ণাচার্যের রচিত মোট ৩২টি দোহার উদ্ধৃতি দিয়েছেন। প্রতিটি দোহার সাথে কবিকৃত 'মেখলা' নামে সংস্কৃত টীকাও আছে। ভণিতাগুলো এরূপঃ
১. ভণই কাহ্নু মন কহবি ন ফুট্টই।
২. ভাই কাহ্ন ভব ভুংজতে নির্ব্বাণ বি মজ্জই।- ১০ নং দোহা ২২ নং দোহা ।
এরকম ভণিতা চর্যাগীতিতেও আছে। ভণিতা লেখার ঢং উভয় রচনাতে অভিন্ন। চর্যার কৃষ্ণপাদ গৌড়ীয় অপভ্রংশে দোহা লিখতেন। কৃষ্ণপাদ যখন অপভ্রংশে লিখেছেন তখন স্থানীয় লৌকিক ভাষাকেই মর্যাদা দিয়েছেন। নেপাল রাজার গ্রন্থাগার থেকে চর্যাপদের যে পুথিখানি হরপ্রসাদ শাস্ত্রী উদ্ধার করেছিলেন, তা মূলত পদগুলোর সংস্কৃত টীকাভাষ্য। আনুমানিক চৌদ্দ শতকে মুনিদত্ত এটি লিখেছিলেন।
তিনি কানুপার ব্যক্তিগত জীবনের ওপর আলোকপাত করেননি। বিভিন্ন পদের ব্যাখ্যাকালে তিনি কবির নামের সংস্কৃত ভাষাকৃত বিভিন্ন রূপ দিয়েছেন। যথা : কৃষ্ণপাদ, কৃষ্ণাচার্যপাদ কৃষ্ণবজ্রপাদ, কৃষ্ণাচার্যচরণ, কৃষ্ণাচার্য সুন্দর ইত্যাদি। পদর্শীর্ষে নামের অপভ্রংশ বানানও আছে, যেমন-কাহ্নুপাদ। একই ব্যক্তির উদ্দেশ্যে নামগুলো প্রযোজ্য কি না তা মুনিদত্ত স্পষ্ট করে বলেননি। একাধিক কৃষ্ণপাদ সম্বন্ধে এখানেই প্রশ্ন সচকিত হয়ে ওঠে।
তবে মুনিদত্ত কাহ্নপাদকে কৃষ্ণাচার্যপাদরূপে সংস্কৃত বৃত্তিতে লিখেছেন। চর্যার কাহ্নুপাদ তথা কৃষ্ণাচার্যপাদের সাথে ইনি অভিন্ন হবেন বলে আমরা সুনিশ্চিত হতে পারি। তিব্বতের প্রাচীন ঐতিহাসিক লামা তারনাথ তাঁর গ্রন্থে একাধিক কৃষ্ণাচার্যের নাম করেছেন। কোনো এক কৃষ্ণাচার্য পাদ্যনগর বা বিদ্যানগরের অধিবাসী ছিলেন। এটি কর্ণাটকের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত ছিল। উক্ত কৃষ্ণাচার্য ছাড়া তারানাথ একজন ছোটো কৃষ্ণাচার্যের অনুমান করেছেন।
তিনি শঙ্কর, হেবজ্র শ্রেণির তান্ত্রিক গ্রন্থের প্রণেতা। তারানাথ ছোটোকৃষ্ণপাদকে পদকর্তা বিরূপার সাথে অভিন্ন মনে করেন। জালন্ধরীপাদ তাঁর গুরু ছিলেন। এ স্থলে চর্যাগীতির তথ্যের সাথে তারানাথের ব্যাখ্যার মিল আছে। ড. সুকুমার সেনের অভিমত, তিনি রামপালের সমসাময়িক ব্রাহ্মণপন্থি তান্ত্রিক ছিলেন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তাঁর ‘বাংলা সাহিত্যের কথা' গ্রন্থে তার হুবহু তর্জমা দিয়েছেন। তাঁর মতে, কানহ পাদ বা কৃষ্ণচারী সোমপুরীর অধিবাসী ছিলেন।
তিনি জাতিতে কায়স্থ ছিলেন। সোমপুর বিহারে ভিক্ষু থাকাকালে তাঁর গুরু জালন্ধরীপাদ তাঁকে হেবজ্র মতে দীক্ষা দেন। বার বছর সাধনা করে তিনি সিদ্ধি লাভ করেন। অধ্যাত্মশক্তিতে গর্বিত কাহ্নপাদ তিনশ শিষ্য নিয়ে লঙ্কাপুরীর দিকে যাত্রা করলেন। আত্ম-
অহঙ্কারবশত তাঁর অলৌকিক মন্ত্রশক্তি লোপ পেল। পথে বিপদের সময় শুরু এসে তাঁকে উদ্ধার করেন এবং নিজ পৈত্রিকভূমি সলপুত্রে এক তাঁতি শিষ্যের নিকট গমন করতে বললেন। সকল শিষ্যসহ কাহ্নপাদ সলপুত্রে এসে তাঁতিকে খুঁজে বের করলেন। তাঁতি তাকে তান্ত্রিক মতে পরীক্ষা করলেন। তিনি মরার মাংস খেতে বললে কাহ্ন নিজেকে নেকড়ে বাঘে রূপান্তরিত করে তা ভক্ষণ করলেন।
মন্ত্রসিদ্ধ তাঁতি মদ্যমাংসে সকল অতিথির সেবা করলেন। অতঃপর কাহ্নপাদ তাঁতির নির্দেশ অমান্য করে বধোকরার দিকে রওনা হলেন। গন্তব্যপথে এক মন্ত্রজ্ঞানী ডাকিনীর খপ্পরে পড়ে তাঁর মৃত্যু হয়। কাহ্নপাদের জীবনেতিহাস তাই কৌতূহলোদ্দীপক ও অলৌকিকতাপূর্ণ ।
এখানে কাহ্নপার পদের নমুনা দেওয়া হলো :
১. নগর বাহিরি রে ডোম্বি তোহোরি কুড়িআ। ছোই ছোই জাসি বামহণ নাড়িআ 1
২. আলো ডোম্বি তোএ সম করিব মই সাঙ্গ। নিঘিণ কাহ্ন কাপালি জোই লাঙ্গ
৩. এক সো পদমা চউসী পাখুড়ি । তহি চড়ি নাচই ডোম্বি বাপুড়ি ৷ (চর্যা-১০)
কাহ্নপার পদগুলোর ভাব, ভাষা, ছন্দ, অলঙ্কারের মেলবন্ধন অতি সুদৃঢ় বিধায় সেগুলো সাহিত্য রসমণ্ডিত। চর্যাগীতিকারেরা ধর্মমত প্রচারে ব্রতী ছিলেন, কাব্যরূপ নির্মাণে সচেতন ছিলেন না। তারপরেও কাহ্নপার পদগুলো অসাধারণ কাব্যগুণ সম্পন্ন । তাঁর পদগুলোতে বাংলার প্রকৃতি ও মানবজীবনের চিত্র অপূর্ব রোমান্টিক মাধুর্যে ফুটে উঠেছে।
উপমা, রূপক, অনুপ্রাস, শ্লেষ, উৎপ্রেক্ষা, অতিশয়োক্তি প্রভৃতি বিচিত্র অলঙ্কারের সমাবেশ ঘটেছে কাহ্নপাদের পদগুলোতে। কাহ্নপা বা কৃষ্ণাচার্য সাহিত্য অনুরাগী পাঠকের কাছে চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন ।
