চর্যাপদের তান্ত্রিক সাধনা সম্পর্কে আলোচনা কর

চর্যাপদের তান্ত্রিক সাধনা সম্পর্কে আলোচনা কর 

অথবা, “তান্ত্রিক সাধনা ও চর্যাপদ সমসূত্রে গাথা”।- উক্তিটির প্রাসঙ্গিকতা আলোচনা কর। 

অথবা, তান্ত্রিক সাধনার বিভিন্ন দিক আলোচনা কর।

চর্যাপদের তান্ত্রিক সাধনা সম্পর্কে আলোচনা কর
চর্যাপদের তান্ত্রিক সাধনা সম্পর্কে আলোচনা কর 

উত্তর : ভূমিকা : চর্যাপদগুলো বৌদ্ধ সহজিয়াদের সাধন পদ্ধতিমূলক এক প্রকার গান। কিন্তু যে ভাষায় ঐ সাধন পদ্ধতি বর্ণিত হয়েছে সহসা তা বুঝার উপায় নেই। ঐ ভাষাকে তাই নাম দেওয়া হয়েছে সান্ধ্যভাষা। সর্বত্রই একটা অস্পষ্টতা, কিছু বুঝা যায়, আবার কিন্তু বুঝা যায় না। এখানে মনে রাখা প্রয়োজন যে, চর্যাপদের মূল্য আমাদের কাছেই ঐ জাতির গূঢ় ধর্ম কথার জন্য নয়। কেবল ভাষা ও সাহিত্যের প্রয়োজনেই চর্যাপদ আমাদের কাছে অত্যন্ত আদরণীয়।

হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেছেন- “সান্ধ্যভাষার মানে আলো আঁধারি ভাষা, কতক আলো, কতক অন্ধকার, খানিক বুঝা যায়, খানিক বুঝা যায় না। অর্থাৎ এই সকল উঁচু অঙ্গের ধর্ম কথার ভিতরে একটা অন্যভাবের কথাও আছে। সেটা খুলিয়া ব্যাখ্যা করবার নয়। যারা সাধন ভজন করেন, তাহারাই সে অর্থ বুঝিবেন, আমাদের বুঝে কাজ নেই। আমরা সাহিত্যের কথা কহিতে এসেছি, সাহিত্যের কথাই কহিব" । শাস্ত্রী মহাশয়ের এ দৃষ্টিভঙ্গি খুবই যুক্তিযুক্ত।

তন্ত্র বস্তুত কোনো দার্শনিক মত নয়, কতকগুলো আচারের সমষ্টি। সেই তন্ত্রাচার আদিতে হিন্দু বা বৌদ্ধ কোনো ধর্মের সাথেই যুক্ত ছিল না। হিন্দু, বৌদ্ধ ইত্যাদি ধর্মের সাথে তার যোগ পরবর্তীকালের। মহাযানী বৌদ্ধদের মতে শূন্যতা বা করুণার মিলনে বোধচিত্ত উৎপন্ন হয় আর বোধচিত্ত লাভের মধ্য দিয়ে উপনীত হওয়া যায় বোধিসত্তাবস্থায়, তারপর ক্রমে বুদ্ধত্ব লাভ হয়। পার্থিব কোনো বস্তুর নিজস্ব কোনো স্বরূপ বা ধর্ম নেই, সকলি অস্তিত্ববিহীন- এই জ্ঞানই হচ্ছে শূন্যতা- জ্ঞান। 

করুণা হচ্ছে সকল পার্থিব জীবনের মুক্তির জন্য আকুতি। শূন্যতা জ্ঞানের সাথে এই মুক্তির আকুতি মিশ্রিত হয়ে অভিন্ন ভাব প্রাপ্ত হলেই বোধিচিত্ত উৎপন্ন হয়। এই শূন্যতা ও করুণা বৌদ্ধ সহজিয়াদের প্রজ্ঞা ও উপায় পরিণত হয়েছে এবং প্রজ্ঞা ও উপায়ের মিলনাবস্থা হয়েছে একটি পরম সুখময় অন্বয় অবস্থা— এই অবস্থায়ই মহাজানী বৌদ্ধদের বোধিচিত্ত। এই প্রজ্ঞা এবং উপায়ই পরবর্তী পর্যায়ে তন্ত্রশাস্ত্রের ইড়া-পিঙ্গলার সাথে অভিন্ন হয়ে গেছে এবং চন্দ্র-সূর্য, গঙ্গা-যমুনা, লালনা-রসনা, নাদ-বিন্দু, আলি-কালী প্রভৃতি নানা নামে অভিহিত হয়েছে।

তন্ত্রের সাধন পদ্ধতি লক্ষ করলে দেখা যায়, একই ব্যাপারে ভিন্ননামে সহজযানী বৌদ্ধদের মধ্যে রয়েছে। তান্ত্রিকদের মতে, সত্য বিরাজিত আমাদের দেহের অভ্যন্তরে। তান্ত্রিকদের মূল কথাটি হলো- “এই দেহই সত্যের মন্দির, সকল তত্ত্বের বাহন। এটাকেই যন্ত্র করে এর ভিতরেই সকল তত্ত্ব আবিষ্কার করে এর ভিতরেই শিব-শক্তির মিলন ঘটাতে হবে। 

নিজের ভিতরে এই শিব-শক্তির মিলনের দ্বারা সত্য প্রতিষ্ঠা হলেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ভিতর দিয়াও সেই সত্যকে উপলব্ধি করা সহজ হবে। সাধককে তাই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড হতে ফিরে আসতে হবে দেহভাণ্ডে, এটাই তান্ত্রিক সাধনার প্রথম অঙ্গ ।"বিশ্ববিদ্যালয়

তান্ত্রিকদের মতে দেহের মেরুদণ্ড হচ্ছে মেরু পর্বত। এর উত্তরাংশ অর্থাৎ ঊর্ধ্বভাগে রয়েছে সুমেরু এবং কুমেরু সর্বনিম্নে। সুমেরুতে সহস্রার এবং কুমেরুতে মূলাধার চক্র অবস্থিত। মূলাধার চক্রে সার্ধ ত্রিবলিত কুণ্ডলীর মধ্যে কুলকুণ্ডলিনীরূপিণী শক্তি সুষুপ্তা- এই নিদ্রিতা শক্তিকে যোগসাধনার দ্বারা জাগাতে হবে এবং সেই সাধনা বলে তাকে উর্ধ্বাভিমুখে নিয়ে যেতে হবে- বিভিন্ন চক্র অতিক্রম করে সহস্রারে শিবের সাথে মিলন করাতে পারলেই সাধক অদ্বয়সত্য গাভ করবে। 

এখানে বিভিন্ন চক্র অর্থে মূলাধার ও সহস্রারের মধ্যবর্তী পাঁচটি চক্রের কথা বলা হয়েছে। তান্ত্রিকগণ দেহের বিভিন্ন অংশে কয়েকটি চক্রের নির্দেশ করেছেন। যেমন- গুহ্যদেশ ও জননেন্দ্রিয়ের মধ্যভাগের মূলাধার চক্র, জননেন্দ্রিয়ের খুলে স্বধিষ্ঠান চক্র, নাভিতে মণিপুরী চক্র, হৃদয়ে অনাহত চক্র, কণ্ঠে বিশুদ্ধ চক্র, ভ্রূদ্বয়ের মধ্যস্থলে, মতান্তরে তালুতে আজ্ঞা চক্র, পরিশেষে মস্তিষ্ক দেশে সহস্রার।

তান্ত্রিক কায়সাধনার আর এক দিক হচ্ছে দেহের নাড়িকে সংযত করে সাধনার পথে অগ্রসর হওয়া। বাম দিকে ইড়া নাড়ি এবং ডান দিকের পিঙ্গলা নাড়ি যথাক্রমে শক্তি ও শিবরূপে কল্পিত হয়, এখানে মধ্যবর্তী হচ্ছে সুমুন্না। 

এই ইড়া-পিঙ্গলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত অপ্রাণ ও প্রাণ বায়ুকে যোগ সাধনার দ্বারা সুযুস্রাতে এনে মিলন করতে হবে। তারপর সেই সুষুম্না পথে তাকে ঊর্ধ্বাভিমুখে পরিচালিত করে সহস্রারে নিয়ে যেতে হবে। এখানে যাত্রাপথে সেই ষটচক্র অতিক্রম করার ব্যাপার আছে।

মহাযানী বৌদ্ধদের শূন্যতা ও করুণা সহজযানী বৌদ্ধদের প্রজ্ঞা ও উপায়ে পরিণত হয়েছে। এই প্রজ্ঞা ও উপায়ই ললনা ও রসনা নাম নিয়ে পরবর্তী পর্যায়ে ইড়া-পিঙ্গলা থেকে অভিন্ন হয়ে গেছে এবং বোধিচিত্ত অবধূতিকাররূপে শেষ পর্যন্ত অভিন্ন কল্পিত হয়েছে সুষুম্নার সাথে এই ললনা রসনা অবধূতিকা নানা বিচিত্র রূপকে চর্যাপদে আত্মপ্রকাশ করেছে। 

হিন্দুতন্ত্রের অনুকরণে বৌদ্ধতন্ত্রেও চক্রকল্পিত ভাব রয়েছে- তবে এখানে চক্রসংখ্যা ছয়, নয়, চার। এখানে প্রথমে নির্মাণ চক্র, তারপর যথাক্রমে ধর্ম চক্র, সম্ভোগ চক্র ও মহাসুখ চক্র। বজ্রতন্ত্র অনুসারে জননেন্দ্রিয় থেকে নাভি পর্যন্ত স্থান নির্মাণ | চক্র। হৃদয়ে ধর্ম চক্র ও কন্ঠে সম্ভোগ চক্র অবস্থিত। অতঃপর সর্বশীর্ষে মস্তকে স্থাপিত মহাসুখ চক্র।

তাহলে দেখা যায় | নির্মাণ চক্র একই সাথে হিন্দুতন্ত্রের মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান ও মণিপুর এই তিন চক্রে ব্যাপ্ত রাখা হয়েছে। এই তিনটি চক্রই হচ্ছে প্রবৃত্তির রাজ্য। পরবর্তীতে অনাহত চক্র থেকেই নিবৃত্তির রাজ্য শুরু। বৌদ্ধতন্ত্র অনুসারেও, ললনা ও রসনার মিলনে যে বোধিচিত্ত উৎপন্ন হয়, নির্মাণ কার্যে অবস্থানকালে সে হচ্ছে সংবৃত্ত বোধিচিত্ত। এই বোধিচিত্তের স্বভাব চঞ্চল এবং নিচের দিকে ধাবিত হতে থাকে ৷

উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে, যোগ সাধনা বলে রসনা ও ললনাকে নিচের দিকে ধাবিত করতে পারলে সে রূপান্তরিত হয় পরমার্থিক বোধিচিত্তে। এই পরমার্থিক বোধিচিত্তই চর্যাপদে সহজ সুন্দরী, নৈরামণি, নৈরাত্মদেবী প্রভৃতি নামে উল্লিখিত হয়েছে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ