চর্যাপদকে বৌদ্ধগান বলার কি সার্থকতা বুঝিয়ে দাও
চর্যাপদকে বৌদ্ধগান বলার কি সার্থকতা বুঝিয়ে দাও
অথবা, চর্যাপদগুলোকে বৌদ্ধ অধ্যাত্মগীতি বলা কতদূর যুক্তিসঙ্গত? আলোচনা কর
![]() |
| চর্যাপদকে বৌদ্ধগান বলার কি সার্থকতা বুঝিয়ে দাও |
উত্তর : চর্যাপদগুলো গান। এগুলো রূপকের আবরণে ধর্মকে কেন্দ্র করে রচিত। বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যগণ চর্যাগুলো রচনা করেছেন। তাঁরা ধর্মমত প্রচার করতে চেয়েছেন। তাঁরা একটি বিশেষ ধরনের তত্ত্ববাদ ও গুহ্য সাধনাকে প্রাকৃত অপভ্রংশের প্রকীর্ণ কবিতার মতো স্বল্পতম আয়তনের মধ্যে নানা সংকেতের সাহায্যে ব্যক্ত করতে চেয়েছিলেন। তাই পদগুলো আধ্যাত সাধনা সম্পৃক্ত। চর্যাগীতিতে বর্ণিত ধর্মীয় ইঙ্গিত, সাধন প্রণালির বিবরণ ও বিভিন্ন পারিভাষিক শব্দের উল্লেখ স্পষ্টই বুঝা যায়, এই গানগুলোর মূল পটভূমিকা হচ্ছে বৌদ্ধধর্ম। বৌদ্ধধর্মে নির্বাণের কথা আছে।
মানুষ যদি অবিদ্যাকে উপেক্ষা করে জাগতিক মিথ্যা-বাসনা-কামনা ত্যাগ করতে পারে তবে সে দুঃখ নিরোধ করতে সক্ষম হবে এবং এভাবেই সে নির্বাণ লাভ করতে পারবে। বৌদ্ধধর্মের দুটি শাখা- মহাযান ও হীনযান সাধন পন্থা। হীনযানীয়া নির্বাণ লাভের উপর গুরুত্ব দিয়েছে। শূন্যতার সাধনা করেই নিজের অস্তিত্বকে বিলুপ্ত করা সম্ভব বলে তারা বিশ্বাস করে।
আর মহাযানীরা মনে করে নির্বাণ লাভ করার সাধনার চেয়ে বৌদ্ধত্ব লাভ করার সাধনাটাই ধড়ো। মহাযানীদের ধর্মাচরণের উদ্দেশ্য শুধু নিজের মুক্তি লাভ নয়, সমগ্র জীবের মুক্তিলাভ এবং এঁদের চূড়ান্ত লক্ষ্যও বোধিসত্তাবস্থা লাভ। হীনযানীরা ছিলেন নিষ্ঠাপূর্ণ আচারপরায়ণ, মহাযানীরা গভীবদ্ধ নিষ্ঠাপরায়তায় বিশ্বাসী নয়। তাদের কাছে মনের জগতে ধ্যান করে নিজেকে শুদ্ধ করার সাধনাই বড়ো।
মহাযানী সাধন পদ্ধতিতে অন্য ধর্মের নানা ধারার অনুপ্রবেশ ঘটার ফলে এতে তান্ত্রিক ধ্যানধারণার ছোঁয়া এসে লাগে। অষ্টম-নবম শতকে গুহ্য সাধনতত্ত্ব, পূজা আচার ও নীতি পদ্ধতির প্রয়োগ এবং প্রচলন মহাযান সাধন পন্থায় অনুপ্রবেশ করে। অনেকের ধারণা, মহাযানী পন্থার ব্রাহ্মণ্য ধর্মের তান্ত্রিকতা এবং রহস্যময় মন্ত্র বৌদ্ধধর্মে অনুপ্রবিষ্ট হয়েছে। অরণ্যাচারী মানুষেরা অলৌকিক, অপ্রাকৃত যাদুশক্তির উপর বিশ্বাস রাখত। তাদের কাছ থেকেই মন্ত্রতন্ত্র বৌদ্ধধর্মে প্রবেশ করেছে।
মহাযানী সাধন পদ্ধতিতে মন্ত্রতন্ত্র এবং নতুন ধ্যানধারণার প্রতিষ্ঠার ফলে তাদের ধর্মাচরণেও বিবর্তন দেখা দেয়। এই বিবর্তনের ফলেই মন্ত্রযান সম্প্রদায়ের উদ্ভব। তাদের কাছে সহজ জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে জীবনকে মুক্তি দেওয়ার প্রয়াসই হলো প্রধানতম সাধনা।
বৌদ্ধধর্মের আরেকটি শাখার নাম বজ্রযান। মন্ত্রযানের গোড়ার দিকে সম্ভবত তন্ত্রের বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে মন্ত্র, মুদ্রা ও মণ্ডলই বিশেষভাবে গৃহীত হয়েছিল, পরে অন্যান্য উপাদানও গৃহীত হয়েছিল। এই অন্যান্য উপাদানের মধ্যে তান্ত্রিক যৌনাচার ও যৌগিক কায়সাধনা পরবর্তীকালে বিশেষ প্রাধান্য লাভ করেছিল। এই তান্ত্রিক আচার-স্বীকৃতির সাথে সাথে মন্ত্রযান বৌদ্ধধর্মে আধ্যাত্মিক দৃষ্টির যে বিভিন্নতা সূচিত হয়। তা-ই সামগ্রিকভাবে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম বা বজ্রযান নামে পরিচিতি লাভ করে। বজ্রযান সাধন পদ্ধতিতে গুরুই হলেন মুক্তি পথের দিশারী। গুরুর কৃপা না হলে সাধকের সিদ্ধিলাভ অসম্ভব। বজ্রযানদের মতে সাধারণ লোকের পক্ষে এই সাধন পদ্ধতির অন্তর্নিহিত তত্ত্ব বুঝা কঠিন। একমাত্র গুরুই শিষ্যকে এ ব্যাপারে জ্ঞান দিতে পারেন।
বজ্রযানী মতের বিবর্তিত রূপান্তর সহজযান। সহজযানীরা দেবদেবী, মন্ত্র-তন্ত্র, আচার-অনুষ্ঠান, যপতপ কোনো কিছু স্বীকার করেন না। বৌদ্ধধর্মের কৃষ্ণ সাধনাও তারা মানতেন না। তারা বিশ্বাস করতেন দেহের মধ্যেই বৌদ্ধ বা পরমজ্ঞান অবস্থান করে। তাদের মতে শূন্যতা হলো প্রকৃতি বা নারী আর করুণা হলো পুরুষ। এ উভয়ের মিলনে যে মহাসুখ বা আনন্দ সেটাই চরম সত্য। এই সত্যকে বুঝতে পারলে ইন্দ্রিয়-কামনা সব নষ্ট হয়ে যাবে। শাস্ত্রজ্ঞান যা শাস্ত্রীয় আচারের জন্য দরকার হয় না। সহজযানীরা দেহবাদ বা কায়ায় সাধনাই মুক্তির একমাত্র পথ বলে নির্দেশ করেছে।
বৌদ্ধধর্মের আরেকটি শাখা আছে, যাকে বলা হয় কালচক্রযান। এই যানের সাধকরা কালচক্রকেই আদি বৌদ্ধ বা সকল বৌদ্ধের জন্মদাতা মনে করেন। নিজেদের কালের প্রবাহের বাইরে নিয়ে যাওয়ার সাধনাই হচ্ছে কালচক্রযান সাধন পদ্ধতি। তিব্বতে এই যানের উৎপত্তি এবং পালরাজাদের আমলে বাংলায় এই মতবাদ প্রচারিত হয়।
বৌদ্ধধর্মের বিভিন্ন যানের সাথে চর্যাপদের সম্পর্ক আছে। তবে মহাযান শাখার বিবর্তিত রূপের সাথে চর্যাপদে বিধৃত ধর্মমতের মিল বেশি। সহজযান, বজ্রযান, মন্ত্রযান কিংবা কালচক্রযান সব ধরনের যানের কথাই চর্যাগীতিগুলোতে আছে। চর্যাপদের আবিষ্কারক আচার্য হরপ্রসাদ শাস্ত্রী চর্যাগীতিগুলোকে বৌদ্ধ সহজিয়া মতের বাংলা গান বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি গ্রন্থটির প্রকাশকালে 'বৌদ্ধগান ও দোহা' নামে প্রকাশ করেন। অধ্যাপক মনীন্দ্র মোহন বসু অধিকাংশ চর্যাগুলোকে সহজিয়া মতের বাহক বলে উল্লেখ করেছেন।
চর্যাপদের গানগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় চর্যাকারগণ লৌকিক জগতের বস্তুকে ধর্মীয় প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করে গুহ্য পূর্বক সংকেত দ্বারা তাঁদের সাধন পদ্ধতির কথা ব্যক্ত করেছেন। চর্যাপদে বিশেষ কোনো মানের সাধন পদ্ধতিকেই বড়ো করে দেখান হয়নি। মহাজন পন্থার বিভিন্ন বিবর্তিত রূপের পরিচয় চর্যায় পাওয়া যায়। কোনো চর্যায় দেহবাদ বা দেহতত্ত্বের আলোচনা আছে আবার কোনো চর্যায় মন্ত্র সাধনা এবং বন্ধু যোগের কথা আছে। বজ্রযান মতের প্রতিফলন দেখা যায় লুইপা, কুক্কুরী পা, কাহ্ন পা, শান্তি পা, বিরূপা রচিত চর্যায়।
চর্যাগীতিতে যে ধর্ম সাধনার ইঙ্গিত আছে তা প্রধানত সহজযান বৌদ্ধধর্মের। সহজযান ধর্মসারনার সাধ্যও সহল, সাধন পদ্ধতিও সহজ। একদিকে সাধনার মাধ্যমে তাঁরা যা পেতে চান তা সহজাত। অন্যদিকে তাঁদের সাধনপদ্ধতিও বক্র নয়, সহজ দেহ। চর্যাগীতিতে অন্যান্য ধর্মের বক্রগামিতার বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে। ১নং চর্যায় কবি লুই পাস ধ্যান সমাধির ব্যর্থতা ঘোষণা করে বলেছেন,
"গজল সমাহিঅ কাহি করিঅই।
সুখ দুখেতে নিচিত মরি অই ॥
এড়িঅউ ছান্দ বান্ধ করণ কপটের আস।
সূনু পথে ভিড়ি লাহুরে পাস
শুধু ধ্যান সমাধিই নয় আগম বেদ পুথিপাঠেও সহজকে পাওয়া যায় না। তাই ৪০ সংখ্যক পদে কাহ্নপা বলেছেন, "জো মন-গোঅর আলালালা। আগম পোখী ইট্ঠা মালা " যা মন-গোচর তা ধোকাবাজি অমনি ধোকাবাজি হচ্ছে আগম, পুথি, ইষ্টমাল্য। অর্থাৎ যা কিছু মন ও ইন্দ্রিয় দ্বারা সৃষ্ট তা সবই মিথ্যা, মায়া। এই মিথ্যা মায়ার দ্বারা সহজ-স্বরূপকে জানা যায় না। অন্যদিকে সহজান্ত ইন্দ্রিয় গোচর নয়। কায়বাকচিত্ত যার মধ্যে প্রবেশ করতে পারে না, সেই সহজ স্বরূপকে ব্যাখ্যা করা যায় কিভাবে? এ ব্যাপারে চর্যাকার কাহ্নপান বলেছেন, “জেতই বোলী তেডবি টাল।” [৪০নং চর্যা]
অর্থাৎ, যে যত ব্যাখ্যা করবে সে তত ব্যর্থ হবে। এ জন্য চর্যাকার সরহ পাদের নির্দেশ- “উত্তুরে উহু ছাড়ি মা লেহু রে বাঙ্ক । নিঅড়ি বোহি মা জাহুরে লাঙ্ক ।” [৩২নং চর্যা] অর্থাৎ সাধনার পথ ছেড়ে বাকাপথে যেও না, বোধি নিকটেই আছে, দূরে (লঙ্কায়) যেও না। চর্যার মাধ্যমে ধর্ম সাধনার কথা সিদ্ধাচার্যরা বলেছেন যে সাধনা মনোময় এবং অনুভূতি প্রধান এবং যে জন্যই তা রহস্যময়। সাধারণ বুদ্ধি দিয়ে তা বুঝা যায় না “অইসনী চর্য্যা কুকুরীপা ঐ গাইল। 'কোড়ি মাঝে একু হিঅহি সমাইল ॥” [২নং চর্যা
অর্থাৎ, এই চর্যা কুক্কুরীপাদ গাইলেন, কোটির মাঝে গুটিকের হৃদয়ে প্রবেশ করল। আবার ভুসুকু পাদ বলেছেন, মূঢ়ের (সাধারণ মানুষের, যারা সাধন তত্ত্ব জানে না) হৃদয়ে কিছুই প্রবেশ করছে না। অর্থাৎ,
“ভুসুকু ভণই মূঢ়া-হিঅহি ণ পইসই ॥' [৬নং চর্যা] চর্যাপদগুলো গুরুশিষ্য পরম্পরায় বিস্তৃত। চর্যাকাররা বলেছেন গুরুর নির্দেশিত পথেই মুক্তি অন্বেষণ করতে হবে এবং শুরুর কৃপা না হলে সাধকের সিদ্ধি লাভ অসম্ভব। ২৮নং চর্যায় শবরপাদ বলেছেন, গুরুবাক্য অনুসারে চিত্তের সাধনা দ্বারা নির্বাণ লাভ সম্ভব হয়েছে-
'গুরুবাক্ ধনুআ বিদ্ধ শিঅ মনে বাণে । একে সর সন্ধানে বিদ্ধহ বিমূহ পরম ণিবাণে চর্যাকারদের প্রত্যয়ে ডোম্বীর একটি বিশেষ সাধনাগত তাৎপর্য আছে। নির্মাণকার্যে নিদ্রিতা অগ্নিরূপিণী শক্তি এই নামেও বারংবার অভিহিতা হয়েছেন। সম্ভোগকায়ে সাধক যদি তার সাথে মিলিত হতে পারেন তবে তাঁর সাধনার সিদ্ধি হস্তগত প্রায়। ডোম্বীর সাথে কাহ্নর বিবাহের বর্ণনায় এই সাধনা সংকেতই এ। ১৯ ও ১০নং চর্যায় কাহ্নপা ডোম্বীকেঅবলম্বন করে কবিতা রচনা করেছেন।
১৯নং চর্যায় পরিশুদ্ধ বধূতিকা ডোম্বীর সাথে পদকর্তা কানুপার মিলন ও মহাসুখ লাভের ব্যাপারটি বিবাহরূপকে বর্ণিত হয়েছে। ডোম্বীকে বিবাহ করে কানুপা জন্ম আমার করলেন এবং অনুত্তর ধাম যৌতুকরূপে লাভ করলেন অর্থাৎ নৈরাত্মারূপিণী ডোম্বীর সাথে মিলিত হয়ে কানুপা পুনর্বার জন্মগ্রহণের সম্ভাবনা থেকে মুক্ত হলেন এবং যৌতুকস্বরূপ লাভ করলেন নির্বাণাবস্থা।
৫নং চর্যায় কবি চাটিল পা খরস্রোতা নদী এবং ক্ষণস্থায়ী জীবন, সেতুবন্ধে দুই তীরের সম্মিলন ও সহজ-সাধনার অদ্বয়বোধ, মোহতরু ছেদন করে সেতু নির্মাণ, একটি আদ্যন্ত পরিচ্ছন্ন খাটি রূপক তুলে ধরেছেন।
চর্যাপদ ধর্ম কথা বা ধর্ম সংগীত। এটি সুপ্রাচীন রহস্যমণ্ডিত ধর্মতত্ত্ব আর সাধন প্রণালি। সহজিয়া মতবাদের নানা সূক্ষ্মতা, বজ্রযান-সহজযান-কালচক্রযানের বিভিন্ন আনুপাতিক মিশ্রণ, যোগ-তন্ত্র কায়া সাধনের অজস্র জটিলতায় এর আনাগোনা। চর্যার মধ্য দিয়ে বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যরা বৌদ্ধধর্মের চিন্তাধারার বিশেষ বিশেষ দার্শনিক অভিপ্রায় আর উপলব্ধি "প্রকাশ করেছে।
চর্যাগীতিকাররা ওহ্য ধর্মপন্থার সাধক ছিলেন এবং সেই সাধনার বিভিন্ন প্রক্রিয়া এবং সেই সাধনালব্ধ নিগূঢ় উপলব্ধির প্রকাশই তাঁদের গান রচনার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। আর এ কারণেই চর্যাপদগুলোকে 'বৌদ্ধগান' বা 'বৌদ্ধ অধ্যাত্মগীতি' বলা হয়ে থাকে।
