চর্যার দর্শনতত্ত্ব ব্যাখ্যা কর

চর্যার দর্শনতত্ত্ব ব্যাখ্যা কর

অথবা, চর্যায় কবিরা বৌদ্ধমত ও দর্শন কিভাবে ব্যবহার করেছেন আলোচনা কর

চর্যার দর্শনতত্ত্ব ব্যাখ্যা কর
চর্যার দর্শনতত্ত্ব ব্যাখ্যা কর

উত্তর : বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন চর্যাপদগুলো একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে রচিত হয়েছিল। চর্যা নাম থেকেই বুঝা যায় যে এই পদগুলোতে তত্ত্বের চেয়ে আচরণের দিকটাই বেশি থাকবে। এর কারণ চর্যাগীতিকাররা যে গুহ্য ধর্মপন্থার সাধক ছিলেন সেই সাধনার বিভিন্ন প্রক্রিয়া এবং সেই সাধনালব্ধ নিগূঢ় উপলব্ধির প্রকাশই তাঁদের গান রচনার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। 

তবে এসব প্রক্রিয়া ও উপলব্ধি সুক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে যে এগুলোর মাধ্যমে বৌদ্ধধর্মীয় চিন্ত াধারার বিশেষ বিশেষ দার্শনিক অভিপ্রায় আর উপলব্ধিই আত্মপ্রকাশ করেছে। অর্থাৎ দর্শনতত্ত্ব এখানে কেন্দ্রীয় বিষয় না হয়ে পটভূমি হিসেবে বিদ্যমান।

চর্যাগীতিতে বর্ণিত ধর্মীয় ইঙ্গিত, সাধন প্রণালির বিবরণ ও বিভিন্ন পারিভাষিক শব্দের উল্লেখ স্পষ্ট বুঝা যায়, তাই গানগুলোর মূল পটভূমিকা হচ্ছে বৌদ্ধধর্ম। তবে বৌদ্ধধর্মের আদিরূপ নয়, কোনো একটি পরিবর্তিত তান্ত্রিকরূপ। বুদ্ধদেবের তিরোধানের পর তাঁর বাণী ও নির্দেশের সঠিক তাৎপর্য নির্ণয় প্রসঙ্গে তাঁর শিষ্যানুশিষ্যদের মধ্যে যে মতবিরোধ দেখা দেয় সেখান থেকেই বৌদ্ধধর্মের রূপ পরিবর্তনের সূত্রপাত। এই মতপার্থক্য দূর করার জন্য কয়েকবার ধর্ম মহাসংঘ আহবান করা হয়, কিন্তু মতভেদ আর দূর হয় না। 

শেষ পর্যন্ত এই মতভেদের সূত্র ধরে বৌদ্ধধর্ম হীনযান ও মহাযান নামে দুটি শাখায় বিভক্ত হয়ে যায়। দুটি শাখার মধ্যে প্রধান পার্থক্য ছিল ধর্মের চূড়ান্ত লক্ষ্য নিয়ে। বৌদ্ধদের মধ্যে একদল ছিলেন অত্যন্ত রক্ষণশীল, এদের ধর্মীয় লক্ষ্য ছিল সংকীর্ণ। এরা মনে করতেন ধ্যান আর কঠোর আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সংসার চক্রের আবর্ত থেকে ব্যক্তিগত মুক্তি তথা মহত্ত্ব লাভই ধর্মাচরণের আসল লক্ষ্য। 

ধর্মাদর্শনের এই আপেক্ষিক হীনতা বা সংকীর্ণতার জন্য এরা হীনযানী। অন্যদিকে, আর একদল ছিলেন ধর্মসাধনার দিক থেকে অপেক্ষাকৃত উদার। এরা হলেন মহাযানী। মহাযানীদের ধর্মাচরণের উদ্দেশ্য শুধু নিজের মুক্তিলাভ নয়, সমগ্র জীবনের মুক্তিলাভ এবং তাঁদের চূড়ান্ত লক্ষ্য ও মহত্ত্বলাভ নয়, বোধিসত্তাবস্থা লাভ।

চর্যাগীতির দার্শনিক পটভূমি মোটামুটি মহাযান বৌদ্ধধর্মের বিভিন্ন দার্শনিক মতবাদের সমন্বয়ে গঠিত এবং এসব মতবাদের মধ্যে নাগার্জুনপাদের শূন্যবাদ বা মাধ্যমিকবাদ এবং মৈত্রের অসঙ্গ বসুবন্ধুর বিজ্ঞানবাদ বা যোগাচারবাদের কথা বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে। এই উভয় প্রকার দার্শনিক মতবাদের কিছু কিছু সিদ্ধান্তগত পার্থক্য আছে, কিন্তু বর্তমান ক্ষেত্রে দর্শনতত্ত্ব নিছক পটভূমির কাজ করায় এসব সিদ্ধান্তগত পার্থক্য সব জায়গায় স্পষ্ট হয়ে উঠেনি। 

অনেকটা অল্প স্পষ্ট আবেষ্টন হিসেবে হয়ত বা পৃথকভাবে অথবা পরস্পর সংলগ্নভাবে বিরাজ করেছে। এমনকি এই তাত্ত্বিক অস্পষ্টতার জন্য চর্যাকারগণ কোথাও কোথাও স্বীয় সাম্প্রদায়িক ধর্মদর্শনের সীমা ছাড়িয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের ব্রহ্মবাদী দার্শনিক সিদ্ধান্তকে স্পর্শ করেছেন।

চর্যাকারগণ দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির এই সম্প্রসারণশীল শিথিলতার জন্য অবশ্য তাদের সমকালীন যুগপ্রভাব অনেকটা দায়ী। সে সময়ে এই গানগুলো রচিত হয়েছিল বঙ্গীয় ইতিহাসের সেই পালযুগে বাঙালি সমাজে ধর্ম ও সংস্কৃতির দিক থেকে এক ধরনের সহজ সমন্বয়ের চেষ্টা করা হয়েছিল। তারই সুযোগে হিন্দু ও বৌদ্ধ দার্শনিক চিন্তাধারাতেও সমন্বয় বা সামঞ্জস্য ঘটেছিল। 

চর্যাগীতির দর্শনতত্ত্বে এই সামঞ্জস্যের প্রকাশ সুস্পষ্ট। সামঞ্জস্যের স্বরূপ অনুধাবন করতে হলে শূন্যবাদ ও বিজ্ঞানবাদের মূলসূত্রগুলো সংক্ষেপে আলোচনা করা দরকার। নাগার্জুনের দার্শনিক সিদ্ধান্তের মূলসূত্র হচ্ছে শূন্যতা অর্থাৎ কোনো বস্তুর নিজস্ব স্বরূপ বা ধর্ম নেই। সবকিছু তার নিজের অস্তিত্বের জন্য অন্যের উপর নির্ভরশীল। এই দ্বিতীয় নির্ভরযোগ্য বস্তু আবার তার নিজের অস্তিত্বের জন্য অন্যের উপর নির্ভরশীল।চলে না। 

কেননা কোনোকিছু অসত্য হলে তার বাহ্য স্বরূপও দেখা যেত না। সুতরাং বস্তুর যা পরমার্থ সত্তা তা সত্যও নয়, যে স্বরূপ বা ধর্ম নিজেই অন্যের উপর নির্ভরশীল তাকে শাশ্বত বা সত্য বলা চলে না। আবার তাকে অসভ্যও বলা বিখ্যাত নয়। অর্থাৎ তা আছে তাও বলা যায় না, আবার তা নেই একথাও বলা যায় না। আবার তার অস্তিত্ব বা নাস্তিক কোনটাই যে সত্য নয় তাও বলা যায় না। এভাবে চারটি দিক থেকে নাগার্জুন প্রমাণ করলেন যে, পরমার্থ সত্যকে আমলে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না ।

. নাগার্জুনের শূন্যবাদী সিদ্ধান্তের অন্য দুটি বৌদ্ধ দার্শনিক মতবাদ বৈভাষিক ও সৌত্রান্তিক মতবাদের মাঝামাঝি একটি। মধ্যম পথ অবলম্বিত হয়েছে। বৈভাষিকেরা ধর্মকে ভাবস্বভাব বা অস্তিত্বময় মনে করতেন। অন্যদিকে, সৌত্রান্ত্রিকদের মতেঞ্জ শূন্যস্বভাব বা অলীক। নাগার্জুন পরমার্থ সত্যের পর্যালোচনায় এই অস্তিত্ব- নাস্তিত্বের কোনটিকেই চূড়ান্তভাবে গ্রহণ করেননি। এই দুইয়ের সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ করে একটি মধ্যপথ নির্দেশ করেছেন। এজন্য তার মতবাদের অন্য নাম মাধ্যমিকবাদ।

অন্যদিকে, বিজ্ঞানীরা বস্তুত স্বভাবশূন্যতা স্বীকার করলেও এই শূন্যতা শূন্যবাদের মতো একেবারে নেতিবাচক নয়। এদের মতে ধর্ম বা বস্তুর প্রকৃত কোনো সত্তা না থাকলেও অবভাসিক বা সাংবৃত্তিক অস্তিত্ব আছে। চিত্ত যখন অধিবিদ্যার প্রভাবে বিক্ষুব্ধ হয় তখনই নানাবিধ অবভাস দেখা দেয়। বহির্বস্তুর উপলব্ধি হয়। দেশকালের বোধ জাগে এবং গ্রাহ্য গ্রাহকভাব সঞ্চারিত হয়। 

এই অবভাস তৈমিরিক বা চক্ষুরোগগ্রস্ত ব্যক্তির দেখা বস্তুসমূহের মতো অলীক। অতএব বিজ্ঞানবাদের মতে, পরিদৃশ্যমান কোনোকিছুই পরমার্থ নয়, সমস্তই 'বিজ্ঞান'। এই বিজ্ঞানের পরিণামেই অলীক ত্রিজগতের অবভাস এবং বিজ্ঞানের নিবৃত্তিতে অর্থাৎ 'বিজ্ঞপ্তিমাত্রতায়' এই অবভাসের বিনাশ। বিজ্ঞানীদের কাছে এই বিজ্ঞপ্তিমাত্রতাই পরমার্থ সত্য। বিজ্ঞপ্তিমাত্রতা যোগীর সিদ্ধিলাভের চূড়ান্ত অবস্থা।

বিজ্ঞানীরা যেভাবে বস্তুর সাংবৃত্তিক সত্তা এবং সাংবৃত্তিক সত্তার অতীতে ‘অভূতপরিকল্প' ‘বিজ্ঞপ্তিমাত্রতা'র কথা চিন্তা করেছেন তার সাথে শঙ্করাচার্যের অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের অনেকটা মিল আছে। শঙ্করচার্যও সত্তাকে প্রতিভাসিক, ব্যবহারিক ও পারমার্থিক এই তিন ভাগে ভাগ করেছেন। প্রতিভাসিক ও ব্যবহারিক সত্তার প্রকৃত অস্তিত্ব নেই। 

অবিদ্যা বা মায়ার প্রভাবে এর সৃষ্টি। মায়ার প্রভাবেই অসার সত্তাকে সার সত্তা বলে মনে হয়। পরমার্থ সত্তার স্বরূপ নির্ণয়ে বৌদ্ধ দর্শনের সাথে মত সাদৃশ্যের জন্যই শঙ্করাচার্য বৈষ্ণবদের কাছে 'প্রচ্ছন্ন ধর্ম'। এছাড়া বিজ্ঞানবাদী গ্রন্থাদিতে বিজ্ঞপ্তিমাত্রতা'র যে বর্ণনা পাওয়া যায় তার সাথে বেদান্তভণিত ব্রহ্মস্বরূপের বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই। দুটিই অনির্বাচ্য, অচিন্তনীয় ধ্রুব এবং লোকান্তর।

আলোচনার পরিশেষে বলা যায় যে, শূন্যবাদীদের নির্বাণ পরিকল্পনার সাথেও বেদান্ত ব্রহ্মোপলব্ধির বেশ সঙ্গতি আছে। শূন্যবাদ, বিজ্ঞানবাদ ও বেদান্তের মধ্যে চিন্তাগত ঐক্যের অবকাশ আছে বলেই চর্যাকারদের দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে এক ধরনের সহজ সমন্বয়ের প্রবণতা দেখা দিয়েছিল।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ