চর্যাপদের ৫০ সংখ্যক পদটি মুখস্থ লিখে আধুনিক বাংলা গদ্যে রূপান্ত রিত কর এবং পদটির কাব্যসৌন্দর্য্য বিশ্লেষণ কর
চর্যাপদের ৫০ সংখ্যক পদটি মুখস্থ লিখে আধুনিক বাংলা গদ্যে রূপান্ত রিত কর এবং পদটির কাব্যসৌন্দর্য্য বিশ্লেষণ কর
অথবা, চর্যাপদের যেকোনো একটি পদের কাব্যসৌন্দর্য বিশ্লেষণ কর
অথবা, চর্যাপদের যেকোনো একটি পদ মুখস্থ লিখে আধুনিক বাংলা গদ্যে রূপান্তরিত কর এবং কাব্যসৌন্দর্য বিশ্লেষণ কর
অথবা, শবরপার যেকোনো একটি পদের কাব্য সৌন্দর্য বিশ্লেষণ কর
![]() |
| চর্যাপদের ৫০ সংখ্যক পদটি মুখস্থ লিখে আধুনিক বাংলা গদ্যে রূপান্ত রিত কর এবং পদটির কাব্যসৌন্দর্য্য বিশ্লেষণ কর |
উত্তরা ভূমিকা : ৫০ সংখ্যক পদ শবরপাদনাম রাগ-রামক্রী গঅণত গঅণত তইলা বাড়ী হিএ কুরাড়ী। কণ্ঠে নইরামণি বালি জাগন্তে উপাড়ী ছাড় ছাড় মাত্মা মোহা বিসমে দুন্দোলী । মহাসুহে বিলসন্তি সবরো লইআ সৃণ মেহেলী!হেরি সো মোরি ভইলা বাড়ী খসমে সমতুলা। সুবল এ মোরে কপাসু ফুটিলা তইলা বাড়ী পাসে রে জোহা বাড়ী তা এলা। ফিটেলি অন্ধারি রে আকাস ফুলিলা। কঙ্গুচিনা পাকেলা রে সবরাসবরি মাতেলা।
অণুদিণ সবরো কিম্পি ণ চেবই মহাসুহে ভোলা চারিবাসে গরিলারে দিআঁ চঞ্চালী
তাহ-তোলি সবরো ডাহ কএলা কান্দই সম্ভণ সিআলী মারিঅ ভবমত্তা রে দহ দিহে নিধলি বলী।
হের সে সবরো নিরেবণ ভইলা ফিটিলি সবরালীঃ
আধুনিক বাংলা রূপান্তর : গগনে গগনে তৃতীয় উদ্যান বাটিকা হৃদয়ে কুঠার। কণ্ঠে নৈরাত্মা বালিকা জেগে উঠতেই তা উপড়ে ফেলল। বিষম দ্বন্দ্ব সৃষ্টিকারী মায়ামোহগুলো পরিত্যাগ কর। শবর মহাসুখে শূন্যে মহিলা নিয়ে বিলাস করেন। আমার সে খসম সমতুল্য ঝটিকা দেখে এই আমার সাদা কার্পাস ফুটছে। ওরে, আমার তৃতীয় উদ্যান বাটিকার পাশে সেই সময় জ্যোসনা-বাটিকা প্রস্তুত হলো। দূর হলো অন্ধকার, আকাশ কুসুমিত হলো।
কঙ্গুচিনা পেকে উঠল, ওরে, মাতাল হলো শবর-শবরী। দিনের পর দিন শবর কিছুই অনুভব করে না। মহাসুখে ভোর হয়ে যায়। চার বাঁশের খাট গড়ানো হল চেচাড়ি দিয়ে, তার উপর তুলে শবরকে দাহ করা হলো কাঁদল শকুন-শৃগালী। ভাবমত্তকে মেরে দশ দিকে পিও দেওয়া হলো। দেখ, সে শবর নিশ্চল হয়ে গেল, দূর হলো তার শবরালী।
অন্তর্নিহিত ভাব : শূন্য, অতিশূন্য, মহাশূন্য এবং প্রভাস্বর শূন্য- এই চার প্রকার শূন্যের মধ্যে তৃতীয় মহাশূন্যই হচ্ছে তৃতীয় উদ্যান বাটিকা। হৃদয় দেশে অবস্থিত অনাহত চক্রে রয়েছে প্রভাস্বর শূন্যতারূপ কুঠার। এই কুঠার দ্বারা সমস্ত বিকল্পাদি দোষ ছেদন করে কণ্ঠে নৈরাত্মা বালিকার জাগরণ হলো। তখন পার্থিব মায়ামোহগুলো বিনষ্ট করে পদকর্তা এই নৈরাত্মা বালিকাকে নিয়ে মহাসুখে সেই তৃতীয় উদ্যান বাটিকায় বিরাজ করেন।
কাপাস হচ্ছে চতুর্থ শূন্য কেননা সাদা কাপাসের যেমন কোন বর্ণ বা রং থাকে না, তেমনি প্রভাস্বর হেতু চতুর্থ শূন্যও অর্থহীন। জ্যোৎস্না বাড়ি অর্থে প্রভাস্বর শূন্যতা। সাদা কাপাস ও জ্যোৎস্না বাটিকা প্রভৃতির দ্বারা তৃতীয় মহাশূন্যের পরবর্তী চতুর্থ মহাশূন্যের কথা বলা হয়েছে। তৃতীয় স্তর থেকে চতুর্থ স্তরেও সাধকের উত্তরণ ঘটলে আকাশ কুসুমের মতোই অজ্ঞানান্ধকার বিদূরিত হয়।
মহাসুখ মসে মাতাল হয়ে উঠে সারা চিত্ত। তখন ভব বিকল্পাদি দ্বারা বদ্ধ সংসারের সাধারণ মানুষ শবরের মৃত্যু হয়, তার ইন্দ্রিয়াদি দগ্ধীভূত হয়। সংসারের বিষয় বাসনারূপ শকুন-শৃগাল তাতে কাঁদে। এভাবে ভবমত্ততা বিদূরিত হয়ে শবর নির্বাণ লাভ করে এবং তার শবরালি ঘুছে যাওয়ার অর্থ চিত্ত অচিত্ততায় লীন হয়ে যাওয়া। কাব্যসৌন্দর্য বিচার :
সমাজচিত্র : চর্যার পদগুলোতে সেকালের বাঙালি ও বাংলার বাস্তব সমাজচিত্র অসাধারণ রসমূর্তিতে আত্মপ্রকাশ করেছে। এই পদে আমরা সেকালের পার্বত্য জীবনযাত্রার পরিচয় পাই। যদিও বাংলার পাহাড়গুলো একেবারে প্রান্তসীমা ঘেষে প্রাচীরের মতো দাঁড়িয়ে আছে তবুও সেসব ছোটো ছোটো পাহাড়ে সেকালের বাঙালি জীবনের যে বিকাশ হয়েছিল তার অপূর্ব জীবন্ত আলেখ্য আমরা এ পদে পাই। শবর পা সেকালের পার্বত্য বাংলাকে একেবারে জীবন্ত অমর করে রেখেছেন এই পদে।
চরণ : চর্যার মূল রচনা সমস্তই ১০ চরণের। অধিক যে চার চরণ তিনটি চর্যায় আছে তার মধ্যে এই ৫০ সংখ্যক পদ একটি। ধারণা করা হয় অধিক সে চার চরণ তার পরবর্তী গায়ক বা ব্যাখ্যাকারের যোজনা।
রূপকল্প : এ পদের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত এক শৃঙ্খলিত রূপকল্পে দেখতে পাই। এ পদে ব্যবহৃত রূপকগুলো হলো-
গঅন ⇒ আকাশ, এখানে দেহের রূপক
তইলা বাড়ি
তৃতীয় বাড়ি, তৃতীয় শূন্যের রূপক।
জোহ্না বাড়ী ⇒ চতুর্থ শূন্যের রূপক।
ফল পাকল, সিদ্ধিলাভ হলো।
কঙ্গুচিনা পাকেলা চারি বাস
নৈরামণি ⇒ দেহে অবস্থিত করুণাময়ী শক্তিদেবী।
মহাসুখ ⇒ নির্বাণের আনন্দ ।
নিরেবণ ⇒ নির্বাণ; সকল আকাঙ্ক্ষার পরিতৃপ্ত অবস্থা ।
প্রসাধন কলা : চর্যাপদগুলো সেকালের শেষ রচনা ছিল বলেই এতে প্রসাধন কলা বিদ্যমান। প্রসাধন কলা হচ্ছে চমৎকার নাট্যিক বর্ণনা, শব্দের ব্যবহার, প্রবাদ প্রবচন, প্রাকৃতিক দৃশ্যের বর্ণনা ইত্যাদি যা চর্যাপদে বহুল পরিমাণে উপস্থিত হয়ে রসসঞ্চার করেছে। এ পদে প্রসাধন কলার চমৎকার সমারোহ ঘটেছে। যেমন- প্রাকৃতিক বর্ণনায় দেখা যায়— আকাশে জেগে উঠে শুক্লপক্ষের চাঁদ, জ্যোৎস্নায় প্লাবিত প্রকৃতি, পৃথিবী হাস্যকিত, প্রস্ফুটিত গুচ্ছ গুচ্ছ কাপাস ফুল ভানুকার উজ্জ্বল এবং আকাশ কুসুমিত। এমন প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং নাট্যিক বর্ণনায় পদটির কাব্যসৌন্দর্য বৃদ্ধি পেয়েছে ।
অলংকার : ৫০ সংখ্যক পদের অবয়বে কাব্য রসের বিশিষ্ট উপাদান প্রচুর শব্দালংকার ও অর্থালংকারে খচিত । শব্দালংকারের উদাহরণ-
মারিঅ ভবমত্তা রে দেহ দিহে দিখলি বলি। (বৃত্তানুপ্রাস
এখানে দ' বর্ণটি দুইয়ের অধিক ব্যবহৃত হয়েছে।
অর্থালংকারের উদাহরণ-
হেরি সো মোরি তইলা বাড়ি খসমে সমতুলা।
সুকল এ মোরে কপাসু ফুটিলা। (উপমা)
ছন্দ : বাংলায় আমরা যাকে ত্রিপদী ছন্দ বলি, প্রাকৃতে, অপভ্রংশে তা মরহট্টা চাউবোলা প্রভৃতি নামে প্রসিদ্ধ ৷ এই পদটি এই ছন্দে রচিত-
গঅনত গঅনত/তইলা বাড়ি/হিএ কুবালী। (৮+৮+৮)
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে, অলংকার বিচারে, বিনি সুষমায়, রূপকল্পের ব্যবহারে, চমৎকার নৈসর্গিক বর্ণনায়, ছন্দ ব্যবহারে এবং মানুষের বাস্তব জীবনের চিত্র চিত্রণে শবর পাদের এই পদটি একটি উৎকৃষ্ট কাব্যগুণ সম্পন্ন রচনা ।
