পতনের প্রাক্কালে বাহারি মামলুক শাসকদের বিবরণ দাও

পতনের প্রাক্কালে বাহারি মামলুক শাসকদের বিবরণ দাও
পতনের প্রাক্কালে বাহারি মামলুক শাসকদের বিবরণ দাও

পতনের প্রাক্কালে বাহারি মামলুক শাসকদের বিবরণ দাও

  • অথবা, বাহারি মামলুকদের পতনের প্রাক্কালে শাসক শ্রেণির উল্লেখ কর।

উত্তর : ভূমিকা : ১২৫০ সালে আইয়ুবী সুলতান আস সালিহের মৃত্যুর পর তাঁর বিধবা স্ত্রী সাজার উদ-দার মিশরে মামলুক বংশ প্রতিষ্ঠা করেন। 

তাঁর প্রতিষ্ঠিত এই বাহারি মামলুকগণ ১৩৮২ সাল পর্যন্ত মিশরে রাজত্ব করেছিল। সুলতান আল নাসিরের মৃত্যুর পর তাঁর উত্তরাধিকারীগণ প্রায় ৪২ বছর বাহারি মামলুক বংশের শাসক ছিল। 

কিন্তু নাসির পরবর্তী কোনো শাসকই স্বাধীন ছিল না বরং তারা ছিল আমির ওমরাহদের হাতের পুতুল। এদের কারোরই শাসনকাল দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। 

আমির ওমরাহদের আঙুলের ইশারায় তারা সুলতান হতেন এবং সিংহাসনচ্যুত হতেন। যদিও এ সময়কার শাসকরা ছিলেন দুর্বল ও অযোগ্য।

বাহারি মামলুকদের পরিচয় : মিশরের মামলুকদের অধিকাংশ লোকই ছিল তুর্কি শাখার কুমান গোত্রের এরা বসবাস করত উরাল পর্বতমালা এবং কাস্পিয়ান সাগরের মধ্যবর্তী কিপচাক অঞ্চলে । 

তাঁরা এক সময় মোঙ্গল আক্রমণের ভয়ে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে পশ্চিমে এশিয়া, উত্তর আফ্রিকা এবং মিশরে চলে আসেন। জন্মগতভাবেই এই তুর্কিগণ ছিলেন দুঃসাহসী ফলে আইয়ুবী সুলতান আস সালিহ তাঁর দেহরক্ষী বাহিনীতে বেশ কিছু সৈন্যকে নিয়োগ দেন। 

কিন্তু এক পর্যায়ে তাঁরা স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে এবং কায়রোবাসীর উপর নির্যাতন শুরু করেন। ফলে সুলতান তাদের একটা বড় অংশকে নগরীর বাইরে ফুসতাত নগরীর বিপরীত প্রান্তে নীলনদের অববাহিকায় “রাওদাহ” নামক দ্বীপে বাসস্থানের ব্যবস্থা করেন। 

সুলতান তাদের বাহারি বলে ডাকতেন বলে, এরা বাহারি মামলুক নামেই ইতিহাসে পরিচিত হয়ে উঠতে থাকে। ১২৫০-১৩৮২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় ১৩২ বছরব্যাপী ২৪ জন শাসক ক্ষমতায় ছিলেন। এ বাহারি মামলুক বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন শাজার-উদ-দার।

১. আবু বকর : সুলতান আবু বকরের রাজত্বকালের মেয়াদ মাত্র ২-৩ মাস স্থায়ী হয়েছিল। কাইসুন ঈর্মাবশে বেশতাককে ধৃত করে আলেকজান্দ্রিয়ায় প্রেরণ করেন। 

আর সেখানে সুলতানের আদেশে তাকে হত্যা করা হয়। তাঁর সম্পত্তি সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত করা হয়। পরে আবু বকর কাইসুনকে আটকের পরিকল্পনা করলে কাইসুন উল্টো সুলতানকে বন্দি করেন ।

২. আহমদ : আবু বকরের পর কাইসুন বকরের ৬ বছর বয়স্ক ভ্রাতাকে সিংহাসনে বসান। কিন্তু নাসিরের জ্যেষ্ঠপুত্র শাহাবুদ্দিন আহমদ তখনও কারাকে ছিলেন। 

কাইমুন আহমদকে দমন করার জন্য কেতনুঘা খানকে পাঠালেন। কিন্তু আহমদ কেতবুদ্ধা খানকে স্বীয় নলভুক্ত করে নিলেন। 

পরে আহমদ সিংহাসনে এসে মারাত্মক রকম ভিলাষী হয়ে পড়েন। ফলে ১৩৪২ সালে আমির ওমরাগণ তাঁর স্কুলে তাঁর ভ্রাতা ইসমাইলকে ক্ষমতায় বসান ।

৩. ইসমাইল : ইসমাইল মাত্র ১৭ বছর বয়সে সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি ছিলেন আদর্শ ও দয়ালু রাজা তাঁর রাজত্বকালে তাঁর এক ভ্রাতা বিদ্রোহী হয়ে উঠলে তাঁর নির্দেশে তাকে হত্যা করা হয়েছিল।

এদিকে বড় ভাই আহমদ তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে থাকলে তিনি ১৩৪৪ সালে আক্রমণ করে কারাক দখল করে নেন। 

যুদ্ধে নিহত আহমদের ছিন্ন মস্তক ইসমাইলের দরবারে নিয়ে আসা হলে ইসমাইল ভয় পেয়ে যান এবং অনিদ্রার কারণে ১৩৪৫ সালে তাঁর মৃত্যু হয়।

৪. হাসান : ককেসিয়ান মামলুকেরা এ সময় হোসাইনকে সিংহাসনে বসানোর কথা ভাবলেও পরে তাকে বশে রাখা যাবে না চিন্তা করে তাঁর ১২ বছর বয়স্ক ভ্রাতা হাসানকে সিংহাসনে বসান । 

কিন্তু মন্ত্রীরা তাঁর কাজে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করলে তিনি তাদের বন্দি করার চেষ্টা করতে গিয়ে নিজেই বন্দি ও কারান্তরীণ হয়েছিলেন।

৫. আস সালিহ : নাসিরের পুত্র সালিহ ১৩৫১ সালে মামলুক সিংহাসনে বসেন। তিনি মাত্র ১৪ বছর বয়সে সিংহাসনে আরোহণ করেন। তাঁর উজির ছিলেন একজন খ্রিস্টান। 

তিনি ছিলেন বিপুল অর্থ সম্পদের মালিক। তাকে খ্রিস্টান মত ত্যাগের জন্য বলা হলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করলে তাঁর কাছে থেকে ২০ লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা নগদ আদায় করে তাকে নির্বাসনে পাঠানো হয়। 

এ সময় তাঁর রাজ্যে বিদ্রোহ শুরু হলে তা তিনি দমনের চেষ্টা করলে তাকে বন্দি করা হয় এবং তাঁর ভাই হাসান পুনরায় সিংহাসনে আরোহণ করেন।

৬. আলাউদ্দিন আলী : ১৩৭৬ সালে মাত্র ৬ বছর বয়সে তিনি সিংহাসনে আরোহণ করেন। তাঁর ক্ষমতায় বসার পরপরই তুমাতুমুর ফিরে এসে খলিফাকে রাজ্য দিতে চাইলেন। কিন্তু পুনঃপুন যুদ্ধের পর তাদের পরাজয় ঘটে। পরে তুমাতুমুর শাসনকর্তা নিযুক্ত হয়ে দামেস্কে প্রেরিত হন।

৭. আস সালিহ হাজী : বাহারী মামলুকদের সর্বশেষ শাসক ছিলেন আস সালিহ হাজী। তিনি ছিলেন ২য় শাবানের পুত্র। তিনি ১৩৮১-১৩৮২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাহারী মামলুকদের শাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। 

১৩৮২ খ্রিস্টাব্দে আল বারকুক মারজ আল সাফার যুদ্ধে তাকে পরাজিত করে বুরুজি মামলুক শাসনের প্রতিষ্ঠা করেন।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ১৩৪৮ সালে সুলতান আল নাসিরের মৃত্যুর পর বাহারি মামলুকদের জৌলুস হারিয়ে যায়। এর পর আরো ৪২ বছর যারা ক্ষমতায় ছিল তাঁরা ছিল আমির ওমরাহদের হাতের পুতুল। 

ফলে এ সময় বাহারি মামলুকরা দুর্বল হয়ে পড়ে এবং ১৩৮২ সালে তাদের পতন ঘটে। তারপরেও বাহারী মামলুকদের শাসনামলে মুসলিম শাসনের যে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। 

তার ফলাফল আজও মুসলিম বিশ্ব ভোগ করছে। আর তাই ঐতিহাসিকদের মতে, মিশরে মামলুক শাসনের ইতিহাসে বাহারী মামলুকদের অবদান ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখা থাকবে। 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ