প্রাচীন বঙ্গীয় জীবনের দৈনন্দিন রূপ ধারা তুলে ধর

প্রাচীন বঙ্গীয় জীবনের দৈনন্দিন রূপ ধারা তুলে ধর
প্রাচীন বঙ্গীয় জীবনের দৈনন্দিন রূপ ধারা তুলে ধর

প্রাচীন বঙ্গীয় জীবনের দৈনন্দিন রূপ ধারা তুলে ধর

  • অথবা, প্রাচীন বাংলায় বাঙালিদের 'দৈনন্দিন জীবনের একটি রূপরেখা তুলে ধর।

উত্তর : ভূমিকা : এশিয়া মহাদেশের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের নীল জলরাশি এবং এর দক্ষিণে বাংলাদেশের অবস্থান। পূর্ব ও দক্ষিণে মায়ানমার দেশটি বাদবাকি সীমারেখা জুড়ে রয়েছে ভারত।

হিমালয়ের দক্ষিণে ও বঙ্গোপসাগরের উত্তরে অবস্থিত পূর্ববাংলা ও পশ্চিমবাংলা। এসকল অঞ্চলগুলোর প্রাচীন যুগে কোনো নাম ছিল না। প্রাচীনকালে কখনই বাংলা বলতে এ সমগ্র অঞ্চলকে বোঝাত না ।

প্রাচীন বাংলার জীবনধারা : মানুষের জীবনাচারণে ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের প্রভাব তীব্র। এজন্যই পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের জীবনধারা, আচার-আচরণে এতো বৈচিত্র্য লক্ষ করা যায়।

বাংলাদেশের বিশাল সমভূমি আর প্রচুর নদ-নদী থাকায় বড় একটি সুবিধা হয়েছে। নদী বয়ে এনেছে পলিমাটি। ফলে এদেশের মাটি হয়েছে উর্বর। উর্বর মাটিতে ফলে পর্যাপ্ত ফসল। 

স্বাভাবিকভাবেই এদেশের যোগাযোগের বড় একটি মাধ্যম হয়ে উঠেছে নদীপথ। তাই নৌকা চালনায় দক্ষ হয়ে উঠে এদেশের মানুষ। 

নৌকার একটি বড় প্রভাব রয়েছে বাংলার মানুষের সাংস্কৃতিক জীবনে। নিচে বাংলার দৈনন্দিন জীবনধারার সংক্ষিপ্ত একটি চিত্র তুলে ধরা হলো :

১. কৃষক ও ফসল : প্রাচীনকাল থেকেই বাংলা ছিল কৃষিনির্ভর। কিন্তু ভূমিহীন গৃহস্থ ও সাধারণ কৃষক ও শ্রমিকদের আর্থিক সচ্ছল ছিল না। তখনকার চর্যাগীতিগুলোতে দরিদ্র জীবনের দুঃখবেদনা অভাব-অনটনের পরিষ্কার ছবি পাওয়া যায়। 

প্রাচীনকালে বাংলায় আখের চাষ হতো এবং আখের রস থেকে প্রচুর গুড় ও চিনি প্রস্তুত হয়ে বিদেশে রপ্তানি হতো। তুলা, সরিষা, পান, সুপারি, আম, কাঁঠাল, নারিকেল-কলা, লেবু প্রভৃতি বহু প্রকার ফসল চাষ হতো।

২. খাদ্যাভ্যাস : বাঙ্গালির প্রধান খাদ্য বর্তমানের ন্যায় তখনও ছিল ভাত, মাছ, মাংস, শাকসবজি, ফলমূল, দুধ ও দুগ্ধজাত বিভিন্ন দ্রব্য। যেমন- দই, ক্ষীর, যি ইত্যাদি। 

সাধারণত বাংলার বাইরে ব্রাহ্মণদের জন্য মাছ, মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। সমাজের সভ্য শ্রেণি ও অভিজাত শ্রেণির কাছে মদ্যপান একটা সহজলভ্য বিষয় ছিল। কিন্তু মধ্যবিত্তের কাছে নয়।

৩. পোশাক ও প্রসাধনী : বিভিন্ন উপকরণ থেকে বোঝা যায়, সে কালের পুরুষেরা মালকোচা দিয়ে যে খাটো ধুতি পরত তাতে হাঁটু পর্যন্ত ঢাকা যেত। আর মেয়েরা পরত গোড়ালি পর্যন্ত ঢাকা শাড়ি। 

একখানা ধুতি বা শাড়ি পরাই সাধারণ রেওয়াজ ছিল। কিন্তু মাঝে মাঝে পুরুষরা চাদর বা উত্তরীয় পরত আর মেয়েরা ওড়না ও বডিস ধরনের জামা পরত।

কর্পূর, চন্দন প্রভৃতি প্রসাধনী সামগ্রীর ব্যবহার তখন খুব প্রচলিত ছিল। মেয়েদের সাজগোজ আপা, সিদুর ও কুমকুমের প্রচলন ছিল। পুরুষরা কাঠের খড়ম বা চামড়ার চটি মাঝে মাঝে ব্যবহার করতো।

৪. পরিবহণ ও যোগাযোগ : মানুষ আর মালামাল পরিবহনে এদেশে নৌপথের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। নৌকার একটি বড় প্রভাব রয়েছে বাংলার মানুষের সাংস্কৃতিক জীবনে। 

উপরে বিশাল আকাশ আর নিচে বয়ে চলা নদী। তার উপরে বৈঠা বাইতে গিয়ে মাঝির কন্ঠ থেকে বের হয় মধুর সুর। 

এভাবেই সৃষ্টি হয়েছিল এদের ভাটিয়ালী আর সারি গান। যানবাহনের তখন প্রধান বাহন ছিল গরুর গাড়ি আর নৌকা। হাতি, ঘোড়া, বহু, পালকি | প্রভৃতিও ব্যবহৃত হতো।

৫. বিনোদন : তখনকার দিনে নানা রকম খেলাধুলা ও আমোদ-প্রমোদের প্রয়োজন ছিল। পাশা আর দাবা খেলা খুব চলত, এবং নাচ, গান ও অভিনয়ের প্রচলন খুব বেশি ছিল। 

বীণা, বাঁশি, মৃদঙ্গ, ঢোল, করতাল প্রভৃতি তো তখন ছিলই; আরও জানা যায় যে, মাটির ভাঁড়কেও বাদ্যযন্ত্ররূপে ব্যবহার করা হতো। 

সে সময় দুর্গার অর্চনা উপলক্ষে বরেন্দ্রে বিপুল উৎসব হতো। 'শাৱোদৎসব' নামে এক প্রকার নৃত্যগীতের অনুষ্ঠান হতো। সুবিখ্যাত ছিল বহু দূর দেশেও বাংলায় প্রস্তুত সুতি কাপড়ের চাহিদা তখন খুব বেশি ছিল। 

পাল আর সেন যুগে ব্যবসায়- বাণিজ্যের খ্যাতি তখন সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তাম্রলিপি ও সপ্তগ্রাম ছিল বাংলার কেন্দ্র। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সাথেও বাংলা বাণিজ্য [ ছিল। সেকালে অনেকে প্রচুর ধন সম্পদের অধিকারী ছিল।

৬. বিবাহ : বাংলার মেয়েদের বর্ণনা দিতে গিয়ে ৰাসায়ন তাদের বলেছেন, মৃদু ভাষিণী, কোমলাঙ্গী এ অনুরাগবতী। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো বাংলাতে এ মেয়েদের প্রকৃত স্বাধীনতা ছিল না। 

বিধবা বিবাহ নিন্দিত ছিল। কিন্তু পুরুষের বহুবিবাহে বাধা ছিল না। মৃত স্বামীর চিতায় সহমরণের উল্লেখ রয়েছে। শূদ্র শ্রেণিতে বিবাহ করা অসঙ্গত ছিল। 

কিন্তু তার সাথে অবৈধভাবে বসবাস করা নিন্দনীয় নয়। অনুগ্রহণ ও বিবাহ সম্বন্ধ বিষয়ে কঠোরতা হিন্দু সমাজে ক্রমশ পরিলক্ষিত হয়েছে। কিন্তু জাতিবেদ প্রথা পরিবর্তিত হওয়ার বৃত্তান্ত এত জটিল যে এখানে তার বর্ণনা সম্ভব নয় ।

৭. ধর্ম : ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলে যখন বৌদ্ধধর্ম কতকটা পশ্চাদপ্রসারণ করেছে, তখন বাংলায় পাল যুগে রাজাদের শ্রদ্ধা ও বদান্যতায় বৌদ্ধধর্মের প্রতিষ্ঠা বৃদ্ধি পেয়েছিল। 

পাল রাজারা বৌদ্ধ ও মহাযান সম্প্রদায়ের অনুরাগী ও পৃষ্ঠপোষক হলেও হিন্দু সংস্কৃতি ও পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্য ধর্ম সম্বন্ধেও যথেষ্ট শ্রদ্ধা ও আনুকূল্য প্রদর্শন করতেন ।

উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান ও জলবায়ু আলাদা। প্রাচীন বাংলার মানুষের দৈনন্দিন জীবনাচরণে তাই ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের প্রভাব খুবই তীব্র। 

এজন্যই পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের মধ্যে জীবনধারা ও আচরণে এত বৈচিত্র্য লক্ষ করা যায় । নদীপথ মানুষের জীবন ধারা পরিবর্তন ও অর্থনীতির উপর দারুণ প্রভাব ফেলেছে । 

আবহাওয়া আর নদ-নদীর অবস্থানহেতু প্রকৃতির অফুরন্ত দানে প্রাচীন বাংলা হয়েছিল এক সমৃদ্ধশালী জনপদ । 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ