আধুনিকীকরণ ও উন্নয়নের কৌশলগুলো বর্ণনা কর। তোমার কাছে কোন পন্থাটি অধিক গ্রহণযোগ্য

আধুনিকীকরণ ও উন্নয়নের কৌশলগুলো বর্ণনা কর। তোমার কাছে কোন পন্থাটি অধিক গ্রহণযোগ্য
আধুনিকীকরণ ও উন্নয়নের কৌশলগুলো বর্ণনা কর। তোমার কাছে কোন পন্থাটি অধিক গ্রহণযোগ্য

আধুনিকীকরণ ও উন্নয়নের কৌশলগুলো বর্ণনা কর। তোমার কাছে কোন পন্থাটি অধিক গ্রহণযোগ্য

  • অথবা, আধুনিকীকরণ ও উন্নয়নের বিভিন্ন কৌশল পর্যালোচনা কর। তোমার কাছে কোন পন্থাটি সবচেয়ে অধিক গ্রহণযোগ্য?

উত্তর : ভূমিকা : আধুনিকীকরণ প্রত্যয়টি একদিনের ফসল নয়। এটা বহু বিবর্তনের মাধ্যমে উন্নত পর্যায়ে পৌঁছেছে। 

আধুনিকীকরণ সম্পর্কে Political Modernization Benjamin Schawartz বলেছেন, "Systematic sustained and purposeful application of human energies to the rational control of man's physical and social environment for various human purposes." 

তবে রাষ্ট্রভেদে আধুনিকীকরণ ও উন্নয়ন কৌশলের তারতম্য হয়ে থাকে। এ কৌশল এর মাধ্যমেই মূলত রাষ্ট্রব্যবস্থা টিকে থাকে।

আধুনিকীকরণ ও উন্নয়নের কৌশল (Techniques of modernization and development) : আধুনিকীকরণ ও উন্নয়ন হচ্ছে কোন আধুনিক সমাজ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে পরিচালিত বিশেষ পদ্ধতি। আর এ কৌশলসমূহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রকার হয়ে থাকে। 

এজন্য যেসব বিষয়ের উপর অগ্রাধিকার দেওয়া হয় তা বিভিন্ন প্রকার হয়ে থাকে। এ সম্পর্কে Claude E. Welch বলেছেন, "Method differ the time available differs the priorities differ." 

নিম্নে উন্নয়ন ও আধুনিকীকরণের বিভিন্ন কৌশল আলোচনা করা হল :

G. A. Almond রাজনৈতিক উন্নয়নের তিনটি কৌশলের কথা উল্লেখ করেছেন। যথা : ক. পৃথকীকরণ, খ, সাম্য স্থাপন এবং গ. সামর্থ্য অর্জন।

আধুনিকীকরণ ও উন্নয়নের কৌশল সম্পর্কে বলতে গিয়ে D A Rustow তিনটি পছন্দের কথা উল্লেখ করেছেন। যথা : প্রথম পছন্দটি হচ্ছে আধুনিকীকরণের গতি সংশ্লিষ্ট। এর দু'টি দিক রয়েছে যথা: 

ক. সংস্কার এবং 

খ. বিপ্লব।

দ্বিতীয় পছন্দটি হচ্ছে আধুনিকীকরণের পরিচিতি সংশ্লিষ্ট। এটি হচ্ছে ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সংমিশ্রণের মাধ্যমে আধুনিকীকরণের পথে অগ্রসর হওয়া।

তৃতীয় পছন্দটি হচ্ছে রাজনৈতিক অনুসন্ধানের সময় নির্ধারণ সংক্রান্ত। এর তিনটি দিক রয়েছে। যথা : একাত্মতা, কর্তৃত্ব এবং সমতা।

নিম্নে উন্নয়ন ও আধুনিকীকরণের প্রধান প্রধান কৌশলসমূহ আলোচনা করা হল :

১. সংস্কার (Reformation): সাধারণভাবে, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রচলিত কাঠামো ঠিক রেখে প্রশাসনের কোন দিকের বা অংশের পরিবর্তন, সংযোজন বা বিয়োজন সাধনকে সংস্কার বলা হয়। 

অ্যালবার্ট হার্শম্যান বলেছেন, "যে পরিবর্তনের মাধ্যমে এখনও পর্যন্ত সুবিধাভোগী গোষ্ঠীগুলোর ক্ষমতার বিধিনিষেধ আরোপ করা হয় এবং বিশেষ সুবিধা বঞ্চিত গোষ্ঠীগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থা ও তদনুযায়ী সামাজিক মর্যাদা উন্নত তাই সংস্কার।

” কাজেই একথা বলা যায় যে, সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বে সরকারি কার্যাদি ও নীতি সামান্য পরিমাণে বা ধীরগতিতে পরিবর্তন ঘটে তাকে সংস্কার বলা হয়। 

মূলত তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে আধুনিকীকরণ ও উন্নয়নের কৌশল হিসেবে সংস্কার কর্মসূচি প্রয়োগ করা হয়ে থাকে।

২. বিপ্লব (Revolution) : উন্নয়ন ও আধুনিকীকরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হল বিপ্লব। এর মাধ্যমে অভি সহজে একটি সনাতন সমাজের পরিবর্তন সাধন করা সম্ভব হয় এবং নতুন সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়। 

মূলত একটি গতানুগতিক সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন সাধন করে, আধুনিক সমাজব্যবস্থার জন্য দেওয়ার নামই বিপ্লব। Lenin বলেছেন, “বিপ্লব হল সমাজব্যবস্থার গুণগত পরিবর্তন, যা পুরাতন সমাজব্যবস্থাকে ভেঙেচুরে সুন্দরভাবে নতুন সমাজে পরিণত করে।" 

Prof. S. P. Huntington বলেছেন, “বিপ্লব হচ্ছে সমাজব্যবস্থার এমন একটি মৌলিক পরিবর্তন যেখানে পরিবর্তন আসে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে, সামাজিক কাঠামোতে, নেতৃত্বে, সরকারি কার্যকলাপে এবং নীতিমালায়।” 

বিপ্লবের মাধ্যমে যেসব জায়গায় উন্নয়ন ও আধুনিকীকরণ ঘটেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল। ১৬৮৮ সালের ইংল্যান্ডে, ১৭৭৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে, ১৭৮৯ সালে ফ্রান্সে, ১৯১৭ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে এবং ১৯৪৯ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনে।

৩. আমলাতন্ত্র (Bureaucracy) : সরকারি নীতিমালা বাস্তবায়নের মাধ্যমে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাঠামোর বিকাশ করে থাকে আমলাতন্ত্র তথা আমলাগণ। 

তারা আইনের শাসন কার্যকরী করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এজন্য উন্নয়ন ও আধুনিকীকরণে আমলাতন্ত্র সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সক্ষম হয়।

৪. সুদ্ধিজীবী শ্রেণি (Intellectuals) : রাজনৈতিক উন্নয়ন ও আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বুদ্ধিজীবী শ্রেণি। 

কারণ তারা পাশ্চাত্য শিক্ষা, আদর্শ ও ভাবধারায় দীক্ষিত এবং সংস্কারমুক্ত মন তথা যুক্ত চিন্তার অধিকারী। বুদ্ধিজীবী শ্রেণি তাদের লব্ধ জ্ঞান, দক্ষতা ও কলাকৌশলের সদ্ব্যবহার করে যে কোন দেশের উন্নয়ন ও আধুনিকীকরণ ঘটাতে সক্ষম।

৫. রাজনৈতিক দল (Political party) : তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে উন্নয়ন ও আধুনিকীকরণের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলো সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। 

একটি জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল দেশের প্রত্যেক অঞ্চল থেকে লোক নিয়ে গঠিত হয়। এজন্য জাতীয় জীবনে জাগরণ ও প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি করে আধুনিকীকরণ ও উন্নয়নে রাজনৈতিক দল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

৩. সামরিক বাহিনী (Military ) : বর্তমানে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সামরিক বাহিনী উন্নয়ন ও আধুনিকীকরণে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। কারণ তারা একটি সুশৃঙ্খল, কর্তব্যনিষ্ঠ, আধুনিক ও অগ্রণী প্রতিষ্ঠান হিসেবে সমাদৃত। 

তাদের দ্বারা জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এসব গুণের বিকাশ সাধিত হয় বলে তারা অতি সহজে উন্নয়ন ও আধুনিকীকরণ ঘটাতে সক্ষম হয়।

সংস্কার না বিপ্লব কোনটি অধিক গ্রহণযোগ্য (Which point is most acceptable reformation or revolution): তৃতীয় বিশ্বের একটি অন্যতম দরিদ্র দেশ বাংলাদেশ। এ দেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামো বিশ্লেষণ করলে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, এ দেশের উন্নয়নের অন্য সংস্কার নয়, বিপ্লবই একমাত্র উপায়। 

কেননা বর্তমানে প্রচলিত সমাজকাঠামোর মধ্যে বসেই সুবিধাভোগী গোষ্ঠীগুলো তাদের স্বার্থ রক্ষা করে চলেছে। 

এরূপ অবস্থা থেকে মুক্তির একমাত্র পথ হল বিদ্যমান সামাজিক কাঠামো ভেঙে দেওয়া এবং নতুন কাঠামোর নেতৃত্ব প্রবর্তন করা। 

তাছাড়া বিপ্লবের পক্ষে আরও যেসব যুক্তি রয়েছে সেগুলো হল :

ক. বিপ্লবের মাধ্যমে পুরাতন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও শাসনব্যবস্থার বৈধতার ধরন পরিবর্তন করা সম্ভব

খ. এর মাধ্যমে পুরাতন সামাজিক শ্রেণি বিলুপ্ত হবে এবং নতুন নতুন শ্রেণি গড়ে উঠবে।

গ. সমাজে নতুন রাজনৈতিক প্রক্রিয়া চালু হবে এবং রাজনৈতিক সমাজ পুনর্নির্ধারিত হবে।

ঘ. রাজনৈতিক বৈধতার নতুন ধারণা প্রবর্তিত ও গৃহীত হবে।

৫. নতুন শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে।

চ. নতুন প্রতিষ্ঠানগুলো সমাজের চাহিদা ও আশা-আকাঙ্ক্ষা ধারণ করতে পারবে

ছ. সর্বশ্রেণীর জনগণ রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সুযোগ পাবে।

জ. সমাজে প্রচলিত শ্রেণি ব্যবস্থা বিলুপ্ত হবে এবং শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে।

ঝ. সংক্ষিপ্ত ও সীমিত আনুগত্যের পরিবর্তে রাষ্ট্রীয় আনুগত্যের নতুন মানদণ্ড প্রবর্তিত হবে। 

ঞ. অর্থনীতির নতুন মানদণ্ড নির্ধারিত হবে।

ট. নতুন রাজনৈতিক কৃষ্টির বিকাশ ঘটবে এবং সামাজিক মূল্যবোধের পরিবর্তন হবে। রাজনৈতিক একাত্মবোধের সমস্যা দূরীভূত হবে।

অন্যদিকে, সংস্কারের মাধ্যমে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ বা উন্নয়ন সম্ভব নয়। কারণ সংস্কার প্রচলিত সামাজিক কাঠামোর সম্পূর্ণ পরিবর্তন করে না। 

এটি শুধুমাত্র প্রচলিত ব্যবস্থায় কোন সংকট দেখা দিলে তা থেকে উত্তরণের চেষ্টা করে। ক্ষমতাহীনদের এতে কোন উপকার সাধিত হয় না। 

সংস্কারের ফলে এসব দেশে শ্রেণি ব্যবস্থা ও শোষণ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে। তাছাড়া সংস্কারের মাধ্যমে সকল সমস্যার সমাধান না হয়ে বরং নতুন সমস্যার সৃষ্টি হয়ে থাকে। 

অতীতে বাংলাদেশে বহু সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছিল। যেমন- ভূমি সংস্কার কর্মসূচি, প্রশাসনিক সংস্কার কর্মসূচি ইত্যাদি । কিন্তু এসব কর্মসূচি কেবল কাগজে কলমে ও আলোচনার টেবিলে সীমাবদ্ধ ছিল।

উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, উন্নয়ন ও আধুনিকীকরণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগ হয়। 

এগুলোর মধ্যে বিপ্লব, সংস্কার, রাজনৈতিক দল, আমলাতন্ত্র, বুদ্ধিজীবী শ্রেণি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। তবে তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়ন ও আধুনিকীকরণের জন্য মূলত বিপ্লবই উৎকৃষ্ট পন্থা হিসেবে বিবেচিত। 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ