রাজনৈতিক কর্তৃত্বের প্রকারভেদ আলোচনা কর

রাজনৈতিক কর্তৃত্বের প্রকারভেদ আলোচনা কর
রাজনৈতিক কর্তৃত্বের প্রকারভেদ আলোচনা কর

রাজনৈতিক কর্তৃত্বের প্রকারভেদ আলোচনা কর

  • অথবা, রাজনৈতিক কর্তৃত্বের বিভিন্ন শ্রেণীবিন্যাস আলোচনা কর।

উত্তর : ভূমিকা : Power corrupts man and absolute power corrupts man absolutely. -H. G. Laski A Grammar of Politics).

রাজনৈতিক কর্তৃত্ব রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের আলোচিত বিষয়ের মধ্যে একটি। রাজনৈতিক কর্তৃত্বের সূত্র সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সহজ নয়। 

কারণ রাজনৈতিক কর্তৃত্বের স্থায়িত্ব কর্তৃত্বের সূত্র ও উৎসের উপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল। এ কারণে রাজনৈতিক কর্তৃত্বের উৎস এবং কিভাবে এ কর্তৃত্ব উৎসারিত হয় সে বিষয়ে আধুনিক রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বে বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়।

রাজনৈতিক কর্তৃত্ব : আধুনিক চিন্তাবিদ রবার্ট ডাল (Robert Dahl) এর অভিমত অনুসারে কর্তৃত্ব বলতে বৈধ প্রভাবকে বুঝায়। নাগরিকদের মূল্যবোধের সাথে কর্তৃত্বপূর্ণ ক্ষমতা প্রয়োগের স্বীকৃতিই হল 'বৈধতা'। 

এ প্রসঙ্গে আলফ্রেড ডি গ্রাজিয়া (Alfred De-Grazia) বলেন, কর্তৃত্ব হল বৈধ ক্ষমতা (Legitimate power)। সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার (Max Weber) বৈধ ক্ষমতা বা ক্ষমতা ও বৈধতা'র সমন্বিত রূপকে বুঝানোর চেষ্টা করেছেন। 

অর্থাৎ কর্তৃত্ব সৃষ্টি হল ক্ষমতা ও বৈধতা এ দুটি উপাদানের সমন্বয়ে। Max Weber তাঁর The Theory of Social and Economic Organizations' শীর্ষক রচনায় রাজনৈতিক কর্তৃত্ব সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। ওয়েবারের অভিমত অনুসারে বৈধতা হল নাগরিকদের সামঞ্জস্যপূর্ণ ক্ষমতা প্রয়োগের স্বীকৃতি।

রাজনৈতিক কর্তৃত্বের শ্রেণীবিভাগ : জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার তাঁর The Theory of Social and Economic Organization' শীর্ষক গ্রন্থে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। 

অধ্যাপক বল বলেছেন, "The German Sociologist Max Weber suggested a threefold classification of the sources of political authority in the modern state."

রাজনৈতিক কর্তৃত্ব হল :

১. সাবেকি কর্তৃত্ব (Traditional authority),

২. সম্মোহনী কর্তৃত্ব (Charismatic authority) এবং

৩. আইনানুগ আমলাতান্ত্রিক বা আইনানুগ যুক্তিবাদী কর্তৃত্ব (Legal-bureacuratic or legal rational authority)। 

নিম্নে তিন ধরনের কর্তৃত্বের আলোচনা করা হল :-

১. সাবেকি কর্তৃত্ব (Traditional authority) : সাবেকি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় ঐতিহ্যের বৈধতার স্বীকৃতির ভিত্তিতে। বংশানুক্রমিক শাসনের একটা ঐতিহ্য থাকে এবং সে ঐতিহ্যের পিছনে অনুমোদন থাকে। 

ক্ষমতা প্রয়োগের বৈধতাকে এ অনুমোদন প্রতিষ্ঠিত করে। শাসকের মর্যাদা ঐতিহ্যের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকে এবং ব্যক্তিগতভাবে শাসকের প্রতি জনগণ তাদের আনুগত্য প্রদর্শন করে থাকে। 

ম্যাক্স ওয়েবার (Max Weber) তাঁর The Theory of Social and Economic Organization' শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন, "Here the obligation of obedience is not based on the impersonal order, but is a matter of personal loyalty within the area of accustomed obligations." অতএব সুদীর্ঘকালের ঐতিহ্যই হল সাবেকি কর্তৃত্বের উৎস। এ হল কর্তৃত্বের একটা সর্বজনীন রূপ।

বংশগত শাসনের ঐতিহ্যের ভিত্তিতেই সাবেকি কর্তৃত্বকে প্রতিষ্ঠিত দেখা যায়। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক বল বলেছেন, Traditional authority, the right to rule resulting from the continuous exercise of political power. Hereditary ruling families fit into this classification."

অতীতের প্রতি মানুষের অন্ধ আনুগত্য অনস্বীকার্য। এ আনুগত্যের ভিত্তিতে ঐতিহ্যবাহী কর্তৃত্বের সৃষ্টি হয়। ওয়েবারের অভিমত অনুসারে রাজনৈতিক কর্তৃত্বের আদি ও সর্বজনীন রূপ হল এ ঐহিত্যবাহী কর্তৃত্ব। 

এক্ষেত্রে দীর্ঘকালীন ঐতিহ্যের অনুমোদনের মধ্যেই ক্ষমার বৈধতা নির্ভর করে। ক্ষমতার বৈধতার স্বীকৃতির জন্য এক্ষেত্রে বিচারবুদ্ধির বৈধতাকে স্বীকার করা হয় না। 

ঐতিহ্যবাহী কর্তৃত্বের উপযুক্ত উদাহরণ হিসেবে গ্রেট ব্রিটেনের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় রাজতন্ত্রের কর্তৃত্বের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

২. সম্মোহনী কর্তৃত্ব (Charismatic authority) : অনন্য সাধারণ ব্যক্তিগত গুণাবলির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত কর্তৃত্বকে বলা হয় সম্মোহনী কর্তৃত্ব। এ হল কর্তৃত্বের অত্যন্ত প্রাচীন এক রূপ। 

ব্যক্তিগতভাবে আনুগত্য অর্জনের সামর্থ্যই হল সম্মোহনী কর্তৃত্বের ক্ষেত্রে মূল বিবেচ্য বিষয়। বিশেষ কোন ব্যক্তির এ ধরনের সম্মোহনী কর্তৃত্ব থাকতে পারে। 

যেমন-বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সম্মোহনী কর্তৃত্ব ছিল। অর্থাৎ ব্যক্তিগত অসাধারণ গুণাবলির জন্য অনেক সময় বিশিষ্ট কোন ব্যক্তিকে সাদরে সর্বজনস্বীকৃত হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ক্ষমতা প্রয়োগের বৈধতা ও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠিত হয় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগত গুণাবলির মাধ্যমে।

সমাজজীবনের সকল ক্ষেত্রে এ ধরনের ব্যক্তিগত গুণাবলির সৃষ্টি হতে পারে। এক্ষেত্রে ব্যক্তির ভাবাবেগ ও ব্যক্তিত্ব প্রবলভাবে প্রকাশ পায়। 

সম্মোহনী রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রসঙ্গে অধ্যাপক বল বলেছেন, "Charismatic authority which results from exceptional personal characteristics of the political leader."

এ ধরনের রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে কার্যকর করার জন্য ব্যক্তিগত গুণাবলি ও সামর্থ্যকে একটা আনুষ্ঠানিক আকার বা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া দরকার। 

এ উদ্দেশ্যে শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ও আইন আবশ্যক। সম্মোহনী কর্তৃত্বের ভিত্তিকে সুদৃঢ় করার জন্য ব্যক্তিগত গুণাবলির সঙ্গে সরকারি ক্ষমতার আনুষ্ঠানিক সমন্বয় সাধন প্রয়োজন ।

৩. আইনানুগ আমলাতান্ত্রিক বা আইনানুগ-যুক্তিবাদী কর্তৃত্ব (Legal bureaucratic or legal rational authority) : সাম্প্রতিক কালের সকল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইনানুগ যুক্তিবাদী কর্তৃত্ব পরিলক্ষিত হয়। আইনের দ্বারা সুস্পষ্টভাবে নির্দিষ্ট নির্দেশ ও পদ্ধতির ভিত্তিতে আইনানুগ যুক্তিবাদী কর্তৃত্বের উদ্ভব হয়। 

এখানে আইনই হল ক্ষমতার উৎস। যারা ক্ষমতা প্রয়োগ করেন, আইনের উৎস থেকেই তারা ক্ষমতা লাভ করেন। এক্ষেত্রে ক্ষমতা প্রয়োগ বৈধ ও ন্যায্য প্রতিপন্ন হয় এই কারণের জন্য যে, ক্ষমতা প্রয়োগ করা হয় প্রচলিত আইন অনুসারে। 

এ প্রসঙ্গে ম্যাক্স ওয়েবার বলেছেন, "It extends to the persons exercising the authority of under it only day virtue of the formal legality of their commands and only within the scope of authority of the office."

উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এবং বিশেষ আধুনিক কালের গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় সাংবিধানিকতা ও আইনের অনুশাসন নীতির প্রেক্ষিতে কর্তৃত্ব হল অতিমাত্রায় আইনানুগ যুক্তিবাদী। 

রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, কোন রাজনৈতিক নেতা প্রভৃতি যে কোন রাজনৈতিক ক্রিয়াকারীকে তাঁর ক্ষমতার যথার্থতা প্রমাণ করতে হয় তার আইনানুগ পদের পরিপ্রেক্ষিতে। এ কর্তৃত্বের উৎস হল সংশ্লিষ্ট আইনানুমোদিত পদ। 

তবে এ কর্তৃত্বকে সুসংহত ও সুদৃঢ় করার জন্য এবং অব্যাহত রাখার জন্য সম্মোহনী ও সাবেকি কর্তৃত্বমূলক উপাদানের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয় ।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ